কুলখানি মৃতের আত্মীয়স্বজনের প্রতি এক ধরণের জুলুম!, বর্বরতা! ,
কারো মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে তার নামে কুলখানি খাওয়ানোর একটা বর্বর রেওয়াজ এই উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত আছে। এর পেছনে হাদিস-কোরানসিদ্ধ কোনো ভিত্তি আছে বলে খোঁজ পাইনি। বরং, এর মধ্যে রয়েছে এমন এক পৈশাচিকতা যে, এ জাতীয় আয়োজন করে আমরা হয়তো জানান দিচ্ছি যে, তিনি মারা গিয়ে আমাদের বাঁচিয়েছেন, তাই আমরা খাওয়ানোর উৎসব করছি।
একজন ব্যক্তির মৃত্যু তার স্বজনদের জন্য অবিসংবাদিতভাবেই অপূরণীয় এক ক্ষতি। পিতৃবিয়োগ বা মাতৃবিয়োগ-পরবর্তী অব্যবহিত কয়েকটি দিন সন্তানের কেমন কাটে, কষ্টের কারবালা কীভাবে আপাদমস্তক রক্তাক্ত করে, বেদনার বিদ্যুৎপ্রবাহ কীভাবে চোখদেরকে স্পৃষ্ট করে, মস্তিষ্ক কীভাবে কতটা অসাড় হয়, শরীরের অঙ্গেরা কতটা অঙ্গার হয়, সশব্দ চিৎকারেরা নিঃশব্দে মিলিয়ে গেলে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন হয়; এ কেবল তারাই জানেন, যাদের বাবা বা মা মারা গিয়েছেন।
এমন ট্রাজেডির পর সন্তানের ফোলা চোখ স্বাভাবিক হতেই যেখানে দেড়-দুই সপ্তাহ কেটে যায়, ক্ষুধামন্দা সারতেই যেখানে অন্তত একমাস লেগে যায়, অনির্দিষ্ট কালজুড়ে যেখানে চোখজুড়ে সেঁটে থাকে কাঁচা কবরের ছবি; সেখানে মৃত্যুর বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই হাজার-হাজার লোক ডেকে খাওয়ানো, খাওয়ানোর যাবতীয় বন্দোবস্ত করা— এ যেন মৃতের সন্তানদের ওপর সামাজিক নির্যাতনের অসামাজিক স্টিম রোলার। সদ্য-পিতা-হারানো একজন পুত্রকে পিতৃবিয়োগের পরদিনই হাটে পাঠিয়ে গরু-ছাগল, চাল-ডাল-মাল কিনতে পাঠানোর মতো নির্মমতা প্রদর্শন বোধহয় কেবল এই উপমহাদেশের মুসলিমদের পক্ষেই সম্ভব।
কুলখানিতে কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করা হবে, কী কী খাওয়ানো হবে, ডালে লবণ কতটা দেওয়া হবে, কাকে কই বসানো হবে, কে কাকে চিবিয়ে খাইয়ে দেবে; সদ্য-পিতৃহারা সন্তানটিকে ইত্যাকার সবকিছু সামলেও শেষতক শুনতে হয় সেই চিরাচরিত বাক্য— গোশতের টুকরোগুলো একটু ছোট হয়েছে, ডালটাও আরেকটু ঘন হলে খেতে ভালো লাগত, ফিরনিতে চিনি বেশি হয়ে গেছে।আবার কুলখানির অনুষ্ঠানে দেখবেন যে বিশেষ করে মহিলারা খুবই পাতলা পরনের জামা-কাপড়, শাড়ি পড়ে যা খুবই অশ্লীল লেখায় মনে হয় যেন বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছে। গ্রাম-গঞ্জের ধূর্ত, রুক্ষ, বিবেকবর্জিত লোকজনের একাংশ এভাবেই কুলখানির খাবারেও ত্রুটি খুঁজে বের করবেই। বিয়ে, খতনা, আকিকার সাথে কুলখানির কোনো তফাৎ এদের কাছে নেই। অন্য আয়োজন গুলোর মতো কুলখানিও এদের কাছে নিছক এক আনন্দ উৎসব।
গ্রাম্য লোকজনের একাংশ যেন অপেক্ষায়ই থাকে মানুষের মৃত্যুর জন্য। মৃত্যু হলেই কুলখানি হবে, কুলখানিতে মাংস-মিশ্রিত ডাল খাওয়া যাবে, খাওয়ার পরে তোলা যাবে তৃপ্তির ঢেঁকুর। যে হাজার-হাজার ব্যক্তি কুলখানিতে খেতে আসে, তাদের কেউই মরহুমের মৃত্যুতে শোকার্ত না; তারা নিছকই ক্ষুধার্ত। শোকার্ত কেবল ঐ কজন, পিতৃবিয়োগের পর চোখ মোছারও সময় না পেয়ে যাদেরকে নেমে পড়তে হয় মৃত্যু উৎসবে যোগ দিতে আসা অনাহূত অবিবেচকদের রসনা-রঞ্জনে।
কুলখানিতে কারা কত হাজার মানুষকে খাওয়াতে পারে, এমনও একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা যুগ-যুগ ধরে উপমহাদেশীয় মুসলিমদের মধ্যে লক্ষণীয়। প্রয়াত ব্যক্তিটি অসুস্থ থাকাকালে কারো দেখা পাওয়া না গেলেও, চিকিৎসায় কারো সহযোগিতা না পাওয়া গেলেও কুলখানিতে নিমন্ত্রণ না পেলে ‘অতি দূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা’ গোত্রের স্বজনরা গোস্বা করে থাকেন এবং এই গোস্বা তাণ্ডবের যাবতীয় চাপ এসে পিষে দিয়ে যায় সদ্য এতিম হওয়া সন্তানদেরকে। এমন না যে, কেউ ভাতের অভাবে কুলখানি খেতে আসেন; কিন্তু কুলখানিতে নিমন্ত্রণ পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে সৃষ্ট বিবাদের রেষ বয়ে বেড়াতে হয় বছরের পর বছর। শুনেছি গ্রামাঞ্চলে ইদানীং কোনো ভিখিরি মারা গেলে তার নামেও নাকি পাঁচ-সাতশো লোককে খাওয়ানো হয়। আজকাল ভিখিরির সন্তানরাও এত বড় আয়োজনের আর্থিক সক্ষমতা রাখেন।
No comments:
Post a Comment