ইসলাম ও গণতন্ত্রের সহাবস্থান কি সম্ভব?
.
.
গণতন্ত্র নিয়ে ইসলামের অবস্থান কি? “ইসলামি গণতন্ত্র” বলে কি আদৌ কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে? ইসলামি কোন উদ্দেশ্য পূরণের জন্য গণতন্ত্রকে মাধ্যম [means to an end] হিসেবে কি ব্যবহার করা যেতে পারে?
.
বর্তমানে যে বিষয়গুলো নিয়ে মুসলিম উম্মাহ-র মধ্যে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক, তার মধ্যে গণতন্ত্র অন্যতম। ফিলিস্তিন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা মিশর – একজন মুসলিম যে ভূখণ্ডেই থাকুক না কেন, গণতন্ত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
.
যদি আপনি পশ্চিমা ডিসকোর্সের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন – “গণতন্ত্রই সমাধান” – এটা পশ্চিমা দর্শন শতসিদ্ধ সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। তাদের পলিটিকাল ফিলোসফির ক্ষেত্রে বর্তমানে মূল ফোকাস হল, কিভাবে গনতন্ত্রকে আরো বেশি কার্যকর এবং জনবান্ধব বানানো যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করা। আমাদের দেশের শিক্ষিত প্রগতিশীল এস্টাবলিশমেন্ট – আমাদের লেখক, চিন্তক, সাংবাদিক, সমালোচকরাও উদারনৈতিক পশ্চিমা গণতন্ত্রের মডেলকে সামনে নিয়েই এগুতে চান। এমনকি আমাদের দেশে যারা কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচিত, তারাও গণতন্ত্র আর সোশালিসমের একটা দেশীয় জগাখিচুড়ি মডেলের কথা বলেন। এসব থেকে আপনি বুঝতে পারবেন, আপনি যখন ম্যাক্রো স্কেইলে কোন পরিবর্তনের কথা বলবেন তখন প্রথম আপনাকে যে আদর্শের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তা হল গণতন্ত্র।
.
গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের দেশের মুসলিমদের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন গনতন্ত্র মানে ভোট দেয়া। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে এই মিসকনসেপশান অত্যন্ত ওয়াইডস্প্রেড। আরেকটি প্রচলিত পপুলার ধারণা হল, গণতন্ত্র হল জনগণের মধ্যে শলা-পরামর্শের ভিত্তিতে বা শূরার ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করা। যারা এরকম বলেন, তারা এই ব্যাখ্যার দ্বারা গণতন্ত্রকে ইসলামিক প্রমাণ করতে চান। আবার অনেকের মতে প্রায়োগিক ভাবে গণতন্ত্র হল মুসলিমদের ক্ষমতায় পৌঁছানো, কিম্বা মুসলিমদের দাবি দাওয়া উত্থাপনের ও পূরণের একটি উপকরণ মাত্র।
.
এই সবগুলো ইন্টারপ্রিটেশানই ভুল। বেশ ভালো ভাবেই ভুল। মূলত এগুলো হল গণতন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন দল বা শ্রেণির মানুষের নিজেদের ব্যাখ্যা। একধরণের উইশফুল থিংকিং। যারা গণতন্ত্রের মডেল উপস্থাপন করেছে, প্রচার ও প্রসার করেছে, এবং সাফল্যের সাথে গণতান্ত্রিক মডেলকে ইমপ্লিমেন্ট করেছে, যদি আপনি সেই পশ্চিমাদের দিকে তাকান, তবে আপনি গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ আলাদা একটা ধারণা পাবেন।
.
গণতন্ত্রকে সবচেয়ে সহজে যে একটা শব্দ দিয়ে বোঝানো যায় তা হল – দ্বীন – জীবনব্যবস্থা। এটা একটা জীবন ব্যবস্থা যার কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস [Creed/Aqeedah] আছে, মূলনীতি আছে এবং আইন আছে। দ্বীন শব্দটা আমরা সাধারণত ইসলামের জন্য এক্সক্লুসিভলি ব্যবহার করি। তাই গণতন্ত্রের ব্যাপারে দ্বীন শব্দটার ব্যবহার হয়তো অনেকের কাছেই অস্বস্তিকর লাগতে পারে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই আমরা বুঝতে পারবো – গণতন্ত্র আসলেই স্বতন্ত্র একটি দ্বীন, যার নিজস্ব, আক্বিদা, বিশ্বাস, নীতি, কিতাব, আইন ও উপাস্য আছে।
.
যেমন, ইসলামের একটি নির্দিষ্ট কিতাব; কুর’আন এবং এর পাশপাশি সুন্নাহ আছে, যা মুসলিমদের জন্যব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাস্ট্রীয় নৈতিকতার ফ্রেইমওয়ার্ক ও আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। ঠিক একইভাবে প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট কিতাব আছে, যেটাকে আমরা সংবিধান বা Constitution নামে চিনি। ইসলামের নিজস্ব পেনাল কোড আছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিজস্ব পেনাল কোড আছে। ইসলাম বলে কুর’আন হল সর্বোচ্চ আইন, আর গণতন্ত্র বলে রাষ্ট্রের সংবিধান হল সর্বোচ্চ আইন।
.
কুর’আনে আল্লাহ বারবার বলেছেন ইসলাম ছাড়া আর কোন দ্বীন তিনি গ্রহণ করবেন না। যারা ইসলামের শাসন ছাড়া অন্য কিছু চাইবে বা অন্য কিছু দিয়ে শাসন করবে তারা মুনাফিক, কাফির ইত্যাদি [আন নিসা ৬০, আল মায়িদা ৪৪ ইত্যাদি]।
.
ইসলামকে একমাত্র দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করা ইসলামের Salvific Exclusivity -র অংশ। ইসলামের প্রবেশ করতে হলে, এবং ইমানদার হিসেবে নিজেকে সাব্যস্ত করতে হলে এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়া এবং জান্নাত পাবার জন্য নিজের উপযুক্ততা প্রমাণ করার জন্য ইসলাম এবং ইসলামী শারীয়াহ ছাড়া আর সকল জীবনব্যবস্থা তথা দ্বীনকে অস্বীকার করা বাধ্যতামূলক। এটা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-র শর্তগুলোর মধ্যে একটি শর্ত। মুসলিম হতে হলে ইসলাম ছাড়া অন্য সকল মতবাদ, মতাদর্শ এবং জীবনব্যবস্থা/দ্বীনকে অস্বীকার করতেই হবে। এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াত এবং হাদীস আছে।
.
আলোচনা সংক্ষেপ করার জন্য আমি শুধু একটি আয়াত উল্লেখ করছিঃ
.
“অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।“ [আল-নিসা ৬৫]
.
অর্থাৎ আল্লাহ্ আযযা ওয়া জাল মুসলিমদের কাছ থেকে অ্যাবসলিউট আনুগত্য চান। এটা ইমানের পূর্বশর্ত। একইভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার নাগরিকের কাছ থেকে অ্যাবসলিউট আনুগত্য চায়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের দিকে তাকাই, তবে আমরা দেখতে পাবোঃ
.
“৭৷ (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে৷
.
(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷” [http://tinyurl.com/oobnpus]
.
সংবিধানের এই বিষয়গুলো অস্বীকার করলে কি কি শাস্তি প্রয়োগ করা হবে তা ৭(ক) এবং (খ) তে বলা আছে। সহজ ভাষায়, ইসলামের যেমন বক্তব্য হল, কোন ব্যক্তি যদি কুর’আনের একটি আয়াত অস্বীকার করে তবে সে কাফির, সংবিধানের বক্তব্যই একইরকম। যদি সংবিধানের প্রাধান্যকে কেউ অস্বীকার করে তবে সে রাস্ট্রদ্রোহী বলে বিবেচিত হবে [অর্থাৎ সাংবিধানের উপর কুফর করার অপরাধে তাকে কাফির মুরতাদ ঘোষণা করা হবে!]
.
এখান থেকে দুটো ক্রুশাল পয়েন্ট উঠে আসে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হল জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস মনে করা। জনগণের ভোটের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্ধারিত হবে, এবং তারা আইনপ্রণেতা হিসেবে কাজ করবে। তারা চাইলে হারামকে হালাল আর হালালকে হারামে পরিণত করতে পারব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমা নির্ধারণ করতে পারবে। এটা সরাসরি তাওহীদের বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ৭(২) এর দিকে তাকালে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার স্পষ্ট হয়ে যায়।
.
৭(২) এ বলা হচ্ছে – “…এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷”
.
অর্থাৎ যদি রাষ্ট্র বলে, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যিনা বা ব্যাভিচার হলে সেটার জন্য কোন শাস্তি নেই, আর ইসলাম যদি বলে শাস্তি হবে বেত্রাঘাত কিম্বা রযম, তবে গণতন্ত্রের ধর্ম অনুযায়ী ইসলামের এই বিধান বাতিল বলে গণ্য হবে। যার অর্থ কুর’আনের আয়াতকে বাতিল বলা। সুস্পষ্ট কুফর। যদি রাষ্ট্র বলে রাসূলুল্লাহ এর অবমাননার জন্য কোন শাস্তি নেই, আর ইসলাম যদি বলে অবমাননার শাস্তি মৃত্যুদন্ড, তাহলে গণতান্ত্রিক সংবিধান অনুযায়ী ইসলামের এই বিধান বাতিল বলে গণ্য হবে। যদি রাষ্ট্র বলে সুদ হালাল আর কুর’আন বলে সুদ হারাম, তাহলে কুর’আনকে পেছনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সংবিধানকে প্রাধ্যন্য দিতে হবে। আর যদি আপনি তা না দেন, এবং কুর’আনের পক্ষ নিয়ে সংবিধানের বিরোধিতা করেন, তাহলে আপনি রাষ্ট্রের নাগরিক হবার যোগ্যতা হারাবেন এবং রাষ্ট্রদোহী হিসেবে বিবেচিত হবেন। আর এই “অপরাধের” জন্য রাষ্ট্র চাইলে আপনাকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারবে।
.
অর্থাৎ গণতান্ত্রিক দ্বীনের বাস্তবতা হল, ইসলাম সমর্থনের জন্য আপনি হত্যাযোগ্য। আমরা গণতন্ত্রের অবস্থান সম্পর্কে জানলাম। ইসলামের এই ব্যাপারে কি মত? বাংলাদেশ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে, এ সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান কি?
.
এ বিষয়ে আধুনিক কালের অনেক উলেমার বক্তব্য এবং ফাতাওয়া আছে। কিন্তু আমি তাদের কারো বক্তব্য না তুলে এমন একজনের বক্তব্য তুলে ধরতে চাই, যিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রসিদ্ধ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ইতিহাসবিদ এবং ফাক্বীহ – আল্লামা আবুল ফিদা ইসমাইল ইবন উমার ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ। ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ হলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার ব্যাপারে সাধারণভাবে উম্মাহর মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। সমসাময়িক উলেমাদের রেখে প্রায় ৭ শতাব্দী আগের একজন ‘আলেমের বক্তব্য উপস্থাপনের কারণ কি? প্রথম কারণ হল, সাম্প্রতিক যেকোন বিষয়ে সমসাময়িক উলেমার মতামত তুলে ধরলে বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক কারণে সমালোচনা করার একটা দুঃখজনক ট্রেন্ড আমাদের মধ্যে ভালোভাবেই চালু হয়েছে। এসব অপ্রাসঙ্গিক সমালোচনার নিচে শেষ পর্যন্ত মূল বিষয়টা চাপা পরে যায়। আমি আল্লামা শাইখ ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহর তাতারদের ব্যাপারে প্রদত্ত ফাতাওয়া এবং বক্তব্য তুলে ধরবো। এর ফলে আশা করা যায়, অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা-সমালোচনা আমরা এড়িয়ে যেতে পারবো। কারণ ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহর গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে সাধারণভাবে, এবং বিশেষ করে এই ফাতাওয়ার গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে, মাযহাব-মানহাজ নির্বিশেষে উম্মাহ একমত। দ্বিতীয়ত, যে প্রেক্ষাপটে ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ এই ফাতাওয়া দিয়েছিলেন, তার সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপটের সুগভীর ও মৌলিক সাদৃশ্য বিদ্যমান।
.
ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন মুসলিমদের উপর মঙ্গোলদের শাসনকালের সমকালীন। মঙ্গোলরা যদিও বলতো যে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু তারা কুর’আনের পরিববর্তে শাসনকার্য ও বিচার পরিচালনা করতো, গেঙ্গিস খানের লেখা এক কিতাবের [আল-ইয়াসিক] মাধ্যমে। আল-ইয়াসিক ছিল বিভিন্ন শারীয়াহর মিশ্রনে তৈরি একটা জগাখিচুড়ির মতো। গেঙ্গিস খান ইহুদিদের শারীয়াহ, খ্রিষ্টানদের শারীয়াহ, ইসলামী শারীয়াহর সাথে মঙ্গোলদের গোত্রীয় রীতিনীতি এবং আর নিজের বিভিন্ন মতামত ইচ্ছেমতো মিশিয়ে এই সংবিধান বা কিতাবটি লিখেছিল। অনেকটা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” আর আইন প্রণেতাদের খেয়ালখুশি একসাথে মিশিয়ে “প্রজাতন্ত্রের” সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ বানানোর মতো।
.
সমসাময়িক মঙ্গোলদের আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা ব্যাতীত গেঙ্গিস খানের কিতাব দিয়ে শাসন করার ক্ষেত্রে ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ অত্যন্ত শক্ত মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতটি পড়লে, এর যথার্থতা এবং গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহু বলেছেনঃ
.
“যে রাজকীয় বিধানসমূহের দ্বারা তাতাররা শাসনকার্য পরিচালনা করে, এগুলো গৃহীত হয়েছে তাঁদের রাজা গেঙ্গিস খানের রচিত কিতাব আল-ইয়াসিক থেকে। গেঙ্গিস খান এই কিতাব রচনা করেছিল বিভিন্ন শারীয়াহ থেকে নানা আইন একত্রিত করে। এখানে ইহুদী, নাসারা, ইসলামী শারীয়াহ সবগুলো থেকেই কিছু কিছু গ্রহণ করা হয়েছে, এবং সাথে আরো অন্যান্য উৎসসমূহ থেকেও। এছাড়া এই কিতাবে গেঙ্গিস খানের নিজের চিন্তাপ্রসূত নানা মনগড়া আইনও আছে। আর এভাবে গেঙ্গিসের উত্তরসূরিরা আল্লাহ্র কিতাব ও তাঁর রাসূলের ﷺ সুন্নাহ অনুযায়ী শাসনের বদলে এই কিতাবের আইনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং অনুসরণ করেছে। যারা এরকম করে তাঁরা কাফির এবং তাদের বিরুদ্দে ততোক্ষণ যুদ্ধ করতে হবে, যতোক্ষন না তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ যা নির্ধারণ করেছেন তদানুযায়ী শাসন করার দিকে ফিরে না আসে। যাতে করে, ছোট বা বড়, কোন বিষয়েই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ছাড়া আর কারো বিধান না চলে।“[ তাফসির ইবন কাসির, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৬৩-৬৭, সূরা মায়’ইদার তাফসীর আয়াত ৪০ থেকে ৫০ দ্রষ্টব্য]
.
একই সাথে আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ এই বিষয়ে কি বলেছেন বিবেচনা করুনঃ
.
“অতএব কেউ যদি খাতুমুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ﷺ এর উপর নাযিলকৃত শারীয়াহ ছেড়ে, পূর্বে নাযিলকৃত অন্য কোন শারীয়াহ দ্বারা বিচার করে ও শাসনকার্য চালায়, যা রহিত হয়ে গেছে, তবে সে কাফির হয়ে গেছে। তবে (চিন্তা করুন) সেই ব্যক্তির অবস্থা কি রূপ যে আল-ইয়াসিক্বের ভিত্তিতে শাসন করে এবং একে ইসলামী শারীয়াহ’র উপর স্থান দেয়? এরকম যেই করবে সে মুসলিমদের ইজমা অনুযায়ী কাফির।“ [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ত্রয়োদশ খন্ড, পৃষ্ঠা ১১৯]
.
দেখা যাচ্ছে ইসলামি এবং গণতান্ত্রিক উভয় অবস্থান থেকেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে এই দুই আদর্শের সহাবস্থান সম্ভব না। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা সম্ভন না কারণ ইসলাম সংবিধানের সার্বভৌমত্ব মানে না। এবং গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র এটা মেনে নেবে না। যতক্ষণ মুসলিমরা সংবিধানের সার্বভৌমত্ব না মানার ব্যাপারে চুপ থাকবে ততোক্ষণ হয়তো বা তারা নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলতে পারবে, কিন্তু যখনই তারা ইমানকে আমলে – বিশ্বাসকে কাজে – পরিণত করতে যাবে বা কাজে পরিণত করার দাবি জানাবে তখনই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কঠোরভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে। যদি এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকে তাহলে শাপলা চত্বরের ঘটনাই প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।
.
একইভাবে ইসলাম কখনই কুরআন ছাড়া আর কোন সংবিধানকে মানবে না এবং মালিকুল মুলক আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ছাড়া আর কারো সার্বভৌমত্ব স্বীকার করবে না। কারণ যদি তা স্বীকার করা হয়, তখন সেটা আর ইসলাম থাকে না, তা কুফর ও শিরকে পরিণত হয়। গণতন্ত্রে বিশ্বাস আলটিমেটলি শর্ত দেয় কুর’আন ও শারীয়াহকে অস্বীকার করার। তাহলে এদুটো ব্যাবস্থা কিভাবে কো-এক্সিস্ট করতে পারে, ব্যক্তির চিন্তা ও চেতনায়, কিম্বা রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে? না গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আর না ইসলামের অবস্থান থেকে, কোন ভাবেই এই দুই ধর্মের সহাবস্থান সম্ভব না।
.
যদি কেউ দাবি করে, সে গণতন্ত্রকে পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করছে মাত্র, কিন্তু এতে বিশ্বাস স্থাপন করছে না, বা এতে ইমান আনছে না – তার এই অবস্থান ইসলামি বা গণতান্ত্রিক কোন দিক থেকেই গ্রহণযোগ্য না। তাত্ত্বিকভাবে এবং প্রায়োগিকভাবে গণতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। যতোই কেউ দাবি করুক না কেন যে, সে গণতন্ত্রকে ক্ষমতায় যাবার জন্য বা মুসলিমের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করছেন, সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ গণতন্ত্রে আমাকে ঢুকতেই হচ্ছে সংবিধান ও জনগণের সার্বভৌমত্ব মেনে। মুসলিমের কল্যাণের জন্য ফসলের জন্য যেমন দুর্গার কাছে কিছু চাওয়া যাবে না, দুর্গার প্রশংসা করা যাবে না, ঠিক একই ভাবে গণতন্ত্রের এই মূলনীতিও মানা যাবে না। কারণ এটা সরাসরি তাওহীদে বিশ্বাসের সাথে ব্যাপকভাবে সাংঘর্ষিক। আর তাওহীদের ব্যাপারে কম্প্রোমাইস করলে ঈমানের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
.
গণতন্ত্রের এবং ইসলামের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে আলোচনা করার মতো আরো অনেক দিক আছে। বিশেষ করে, গণতন্ত্রের একটি শিরকি ও কুফরি মতবাদ হবার ব্যাপারে, এবং কথিত “ইসলামি” গণতন্ত্রে ব্যাপারে উপমহাদেশের অনেক সম্মানিত আলিমদের মত তুলে ধরা হয়েছে।
লিংকঃ http://bit.do/Democracy-Akabir
.
আপাতত এখানে শেষ করতে হচ্ছে। শেষ করার আগে সালমান আল ফারসি (রা:) সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিস তুলে ধরছি, যা আমার কাছে এই আলোচনার জন্য খুব অ্যাপ্রোপ্রিয়েট মনে হয়েছে। হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে মুসনাদে আহমাদের, এছাড়া আল বায়হাক্বী এবং ইবনু আবি শায়বাহও হাদিসটি বর্ণনা করেছেন [আলবানীর মতে মারফু সূত্রে এটির সনদ দ্বাইফ, মাওকুফ সুত্রে এর সনদ সাহীহ – সিলসিলা আদ্ব-দ্বাইফা]
.
“রাসূল ﷺ বলেন, এক ব্যক্তি একটি মাছির কারণে জান্নাতে যাবে আর এক ব্যক্তি একটি মাছির কারণে জাহান্নামে যাবে। সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া ইজমাইন গণ বললেন তা কিভাবে?
.
উত্তরে রাসূল ﷺ বললেন: এক কওমের একটি ভাষ্কর্য বা মূর্তি ছিল। ওটার পাশ দিয়ে যেই যেত সেই উক্ত ভাষ্কর্যে কোন কিছু উৎসর্গ না করে যেতে পারতো না। সেখান দিয়ে একবার দু’জন লোক যাচ্ছিল। তাদের একজনকে মূর্তিওয়ালারা বলল কিছু দান করে যাও। সে বলল, আমার কাছে দান করার মত কোন কিছুই নেই। তারা বলল একটি মাছি হলেও তোমাকে উৎসর্গ করতে হবে। সুতরাং সে একটি মাছি উৎসর্গ করল। তারা তার পথ ছেড়ে দিল। এভাবে সে জাহান্নামে প্রবেশের ফায়সালা নিশ্চিত করল।
.
এবার অপরজনকেও বলল: কিছু দান করে যাও। সে জবাবে বলল, আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে কোন কিছুই দান করব না। ফলে তারা তরবারী দিয়ে তার গর্দান উড়িয়ে দিল। কিন্তু সে জান্নাতের ফয়সালা লাভ করল।”
.
.
ব্লগ থেকে পড়ুনঃ https://pursuitoftruthsite.wordpress.com
.
.
.
গণতন্ত্র নিয়ে ইসলামের অবস্থান কি? “ইসলামি গণতন্ত্র” বলে কি আদৌ কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে? ইসলামি কোন উদ্দেশ্য পূরণের জন্য গণতন্ত্রকে মাধ্যম [means to an end] হিসেবে কি ব্যবহার করা যেতে পারে?
.
বর্তমানে যে বিষয়গুলো নিয়ে মুসলিম উম্মাহ-র মধ্যে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক, তার মধ্যে গণতন্ত্র অন্যতম। ফিলিস্তিন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা মিশর – একজন মুসলিম যে ভূখণ্ডেই থাকুক না কেন, গণতন্ত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
.
যদি আপনি পশ্চিমা ডিসকোর্সের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন – “গণতন্ত্রই সমাধান” – এটা পশ্চিমা দর্শন শতসিদ্ধ সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। তাদের পলিটিকাল ফিলোসফির ক্ষেত্রে বর্তমানে মূল ফোকাস হল, কিভাবে গনতন্ত্রকে আরো বেশি কার্যকর এবং জনবান্ধব বানানো যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করা। আমাদের দেশের শিক্ষিত প্রগতিশীল এস্টাবলিশমেন্ট – আমাদের লেখক, চিন্তক, সাংবাদিক, সমালোচকরাও উদারনৈতিক পশ্চিমা গণতন্ত্রের মডেলকে সামনে নিয়েই এগুতে চান। এমনকি আমাদের দেশে যারা কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচিত, তারাও গণতন্ত্র আর সোশালিসমের একটা দেশীয় জগাখিচুড়ি মডেলের কথা বলেন। এসব থেকে আপনি বুঝতে পারবেন, আপনি যখন ম্যাক্রো স্কেইলে কোন পরিবর্তনের কথা বলবেন তখন প্রথম আপনাকে যে আদর্শের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তা হল গণতন্ত্র।
.
গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের দেশের মুসলিমদের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন গনতন্ত্র মানে ভোট দেয়া। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে এই মিসকনসেপশান অত্যন্ত ওয়াইডস্প্রেড। আরেকটি প্রচলিত পপুলার ধারণা হল, গণতন্ত্র হল জনগণের মধ্যে শলা-পরামর্শের ভিত্তিতে বা শূরার ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করা। যারা এরকম বলেন, তারা এই ব্যাখ্যার দ্বারা গণতন্ত্রকে ইসলামিক প্রমাণ করতে চান। আবার অনেকের মতে প্রায়োগিক ভাবে গণতন্ত্র হল মুসলিমদের ক্ষমতায় পৌঁছানো, কিম্বা মুসলিমদের দাবি দাওয়া উত্থাপনের ও পূরণের একটি উপকরণ মাত্র।
.
এই সবগুলো ইন্টারপ্রিটেশানই ভুল। বেশ ভালো ভাবেই ভুল। মূলত এগুলো হল গণতন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন দল বা শ্রেণির মানুষের নিজেদের ব্যাখ্যা। একধরণের উইশফুল থিংকিং। যারা গণতন্ত্রের মডেল উপস্থাপন করেছে, প্রচার ও প্রসার করেছে, এবং সাফল্যের সাথে গণতান্ত্রিক মডেলকে ইমপ্লিমেন্ট করেছে, যদি আপনি সেই পশ্চিমাদের দিকে তাকান, তবে আপনি গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ আলাদা একটা ধারণা পাবেন।
.
গণতন্ত্রকে সবচেয়ে সহজে যে একটা শব্দ দিয়ে বোঝানো যায় তা হল – দ্বীন – জীবনব্যবস্থা। এটা একটা জীবন ব্যবস্থা যার কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস [Creed/Aqeedah] আছে, মূলনীতি আছে এবং আইন আছে। দ্বীন শব্দটা আমরা সাধারণত ইসলামের জন্য এক্সক্লুসিভলি ব্যবহার করি। তাই গণতন্ত্রের ব্যাপারে দ্বীন শব্দটার ব্যবহার হয়তো অনেকের কাছেই অস্বস্তিকর লাগতে পারে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই আমরা বুঝতে পারবো – গণতন্ত্র আসলেই স্বতন্ত্র একটি দ্বীন, যার নিজস্ব, আক্বিদা, বিশ্বাস, নীতি, কিতাব, আইন ও উপাস্য আছে।
.
যেমন, ইসলামের একটি নির্দিষ্ট কিতাব; কুর’আন এবং এর পাশপাশি সুন্নাহ আছে, যা মুসলিমদের জন্যব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাস্ট্রীয় নৈতিকতার ফ্রেইমওয়ার্ক ও আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। ঠিক একইভাবে প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট কিতাব আছে, যেটাকে আমরা সংবিধান বা Constitution নামে চিনি। ইসলামের নিজস্ব পেনাল কোড আছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিজস্ব পেনাল কোড আছে। ইসলাম বলে কুর’আন হল সর্বোচ্চ আইন, আর গণতন্ত্র বলে রাষ্ট্রের সংবিধান হল সর্বোচ্চ আইন।
.
কুর’আনে আল্লাহ বারবার বলেছেন ইসলাম ছাড়া আর কোন দ্বীন তিনি গ্রহণ করবেন না। যারা ইসলামের শাসন ছাড়া অন্য কিছু চাইবে বা অন্য কিছু দিয়ে শাসন করবে তারা মুনাফিক, কাফির ইত্যাদি [আন নিসা ৬০, আল মায়িদা ৪৪ ইত্যাদি]।
.
ইসলামকে একমাত্র দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করা ইসলামের Salvific Exclusivity -র অংশ। ইসলামের প্রবেশ করতে হলে, এবং ইমানদার হিসেবে নিজেকে সাব্যস্ত করতে হলে এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়া এবং জান্নাত পাবার জন্য নিজের উপযুক্ততা প্রমাণ করার জন্য ইসলাম এবং ইসলামী শারীয়াহ ছাড়া আর সকল জীবনব্যবস্থা তথা দ্বীনকে অস্বীকার করা বাধ্যতামূলক। এটা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-র শর্তগুলোর মধ্যে একটি শর্ত। মুসলিম হতে হলে ইসলাম ছাড়া অন্য সকল মতবাদ, মতাদর্শ এবং জীবনব্যবস্থা/দ্বীনকে অস্বীকার করতেই হবে। এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াত এবং হাদীস আছে।
.
আলোচনা সংক্ষেপ করার জন্য আমি শুধু একটি আয়াত উল্লেখ করছিঃ
.
“অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।“ [আল-নিসা ৬৫]
.
অর্থাৎ আল্লাহ্ আযযা ওয়া জাল মুসলিমদের কাছ থেকে অ্যাবসলিউট আনুগত্য চান। এটা ইমানের পূর্বশর্ত। একইভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার নাগরিকের কাছ থেকে অ্যাবসলিউট আনুগত্য চায়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের দিকে তাকাই, তবে আমরা দেখতে পাবোঃ
.
“৭৷ (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে৷
.
(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷” [http://tinyurl.com/oobnpus]
.
সংবিধানের এই বিষয়গুলো অস্বীকার করলে কি কি শাস্তি প্রয়োগ করা হবে তা ৭(ক) এবং (খ) তে বলা আছে। সহজ ভাষায়, ইসলামের যেমন বক্তব্য হল, কোন ব্যক্তি যদি কুর’আনের একটি আয়াত অস্বীকার করে তবে সে কাফির, সংবিধানের বক্তব্যই একইরকম। যদি সংবিধানের প্রাধান্যকে কেউ অস্বীকার করে তবে সে রাস্ট্রদ্রোহী বলে বিবেচিত হবে [অর্থাৎ সাংবিধানের উপর কুফর করার অপরাধে তাকে কাফির মুরতাদ ঘোষণা করা হবে!]
.
এখান থেকে দুটো ক্রুশাল পয়েন্ট উঠে আসে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হল জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস মনে করা। জনগণের ভোটের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্ধারিত হবে, এবং তারা আইনপ্রণেতা হিসেবে কাজ করবে। তারা চাইলে হারামকে হালাল আর হালালকে হারামে পরিণত করতে পারব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমা নির্ধারণ করতে পারবে। এটা সরাসরি তাওহীদের বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ৭(২) এর দিকে তাকালে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার স্পষ্ট হয়ে যায়।
.
৭(২) এ বলা হচ্ছে – “…এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে৷”
.
অর্থাৎ যদি রাষ্ট্র বলে, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যিনা বা ব্যাভিচার হলে সেটার জন্য কোন শাস্তি নেই, আর ইসলাম যদি বলে শাস্তি হবে বেত্রাঘাত কিম্বা রযম, তবে গণতন্ত্রের ধর্ম অনুযায়ী ইসলামের এই বিধান বাতিল বলে গণ্য হবে। যার অর্থ কুর’আনের আয়াতকে বাতিল বলা। সুস্পষ্ট কুফর। যদি রাষ্ট্র বলে রাসূলুল্লাহ এর অবমাননার জন্য কোন শাস্তি নেই, আর ইসলাম যদি বলে অবমাননার শাস্তি মৃত্যুদন্ড, তাহলে গণতান্ত্রিক সংবিধান অনুযায়ী ইসলামের এই বিধান বাতিল বলে গণ্য হবে। যদি রাষ্ট্র বলে সুদ হালাল আর কুর’আন বলে সুদ হারাম, তাহলে কুর’আনকে পেছনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সংবিধানকে প্রাধ্যন্য দিতে হবে। আর যদি আপনি তা না দেন, এবং কুর’আনের পক্ষ নিয়ে সংবিধানের বিরোধিতা করেন, তাহলে আপনি রাষ্ট্রের নাগরিক হবার যোগ্যতা হারাবেন এবং রাষ্ট্রদোহী হিসেবে বিবেচিত হবেন। আর এই “অপরাধের” জন্য রাষ্ট্র চাইলে আপনাকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারবে।
.
অর্থাৎ গণতান্ত্রিক দ্বীনের বাস্তবতা হল, ইসলাম সমর্থনের জন্য আপনি হত্যাযোগ্য। আমরা গণতন্ত্রের অবস্থান সম্পর্কে জানলাম। ইসলামের এই ব্যাপারে কি মত? বাংলাদেশ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে, এ সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান কি?
.
এ বিষয়ে আধুনিক কালের অনেক উলেমার বক্তব্য এবং ফাতাওয়া আছে। কিন্তু আমি তাদের কারো বক্তব্য না তুলে এমন একজনের বক্তব্য তুলে ধরতে চাই, যিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রসিদ্ধ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ইতিহাসবিদ এবং ফাক্বীহ – আল্লামা আবুল ফিদা ইসমাইল ইবন উমার ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ। ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ হলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার ব্যাপারে সাধারণভাবে উম্মাহর মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। সমসাময়িক উলেমাদের রেখে প্রায় ৭ শতাব্দী আগের একজন ‘আলেমের বক্তব্য উপস্থাপনের কারণ কি? প্রথম কারণ হল, সাম্প্রতিক যেকোন বিষয়ে সমসাময়িক উলেমার মতামত তুলে ধরলে বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক কারণে সমালোচনা করার একটা দুঃখজনক ট্রেন্ড আমাদের মধ্যে ভালোভাবেই চালু হয়েছে। এসব অপ্রাসঙ্গিক সমালোচনার নিচে শেষ পর্যন্ত মূল বিষয়টা চাপা পরে যায়। আমি আল্লামা শাইখ ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহর তাতারদের ব্যাপারে প্রদত্ত ফাতাওয়া এবং বক্তব্য তুলে ধরবো। এর ফলে আশা করা যায়, অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা-সমালোচনা আমরা এড়িয়ে যেতে পারবো। কারণ ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহর গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে সাধারণভাবে, এবং বিশেষ করে এই ফাতাওয়ার গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে, মাযহাব-মানহাজ নির্বিশেষে উম্মাহ একমত। দ্বিতীয়ত, যে প্রেক্ষাপটে ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ এই ফাতাওয়া দিয়েছিলেন, তার সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপটের সুগভীর ও মৌলিক সাদৃশ্য বিদ্যমান।
.
ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন মুসলিমদের উপর মঙ্গোলদের শাসনকালের সমকালীন। মঙ্গোলরা যদিও বলতো যে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু তারা কুর’আনের পরিববর্তে শাসনকার্য ও বিচার পরিচালনা করতো, গেঙ্গিস খানের লেখা এক কিতাবের [আল-ইয়াসিক] মাধ্যমে। আল-ইয়াসিক ছিল বিভিন্ন শারীয়াহর মিশ্রনে তৈরি একটা জগাখিচুড়ির মতো। গেঙ্গিস খান ইহুদিদের শারীয়াহ, খ্রিষ্টানদের শারীয়াহ, ইসলামী শারীয়াহর সাথে মঙ্গোলদের গোত্রীয় রীতিনীতি এবং আর নিজের বিভিন্ন মতামত ইচ্ছেমতো মিশিয়ে এই সংবিধান বা কিতাবটি লিখেছিল। অনেকটা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” আর আইন প্রণেতাদের খেয়ালখুশি একসাথে মিশিয়ে “প্রজাতন্ত্রের” সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ বানানোর মতো।
.
সমসাময়িক মঙ্গোলদের আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা ব্যাতীত গেঙ্গিস খানের কিতাব দিয়ে শাসন করার ক্ষেত্রে ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ অত্যন্ত শক্ত মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতটি পড়লে, এর যথার্থতা এবং গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহু বলেছেনঃ
.
“যে রাজকীয় বিধানসমূহের দ্বারা তাতাররা শাসনকার্য পরিচালনা করে, এগুলো গৃহীত হয়েছে তাঁদের রাজা গেঙ্গিস খানের রচিত কিতাব আল-ইয়াসিক থেকে। গেঙ্গিস খান এই কিতাব রচনা করেছিল বিভিন্ন শারীয়াহ থেকে নানা আইন একত্রিত করে। এখানে ইহুদী, নাসারা, ইসলামী শারীয়াহ সবগুলো থেকেই কিছু কিছু গ্রহণ করা হয়েছে, এবং সাথে আরো অন্যান্য উৎসসমূহ থেকেও। এছাড়া এই কিতাবে গেঙ্গিস খানের নিজের চিন্তাপ্রসূত নানা মনগড়া আইনও আছে। আর এভাবে গেঙ্গিসের উত্তরসূরিরা আল্লাহ্র কিতাব ও তাঁর রাসূলের ﷺ সুন্নাহ অনুযায়ী শাসনের বদলে এই কিতাবের আইনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং অনুসরণ করেছে। যারা এরকম করে তাঁরা কাফির এবং তাদের বিরুদ্দে ততোক্ষণ যুদ্ধ করতে হবে, যতোক্ষন না তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ যা নির্ধারণ করেছেন তদানুযায়ী শাসন করার দিকে ফিরে না আসে। যাতে করে, ছোট বা বড়, কোন বিষয়েই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ছাড়া আর কারো বিধান না চলে।“[ তাফসির ইবন কাসির, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৬৩-৬৭, সূরা মায়’ইদার তাফসীর আয়াত ৪০ থেকে ৫০ দ্রষ্টব্য]
.
একই সাথে আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ এই বিষয়ে কি বলেছেন বিবেচনা করুনঃ
.
“অতএব কেউ যদি খাতুমুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ﷺ এর উপর নাযিলকৃত শারীয়াহ ছেড়ে, পূর্বে নাযিলকৃত অন্য কোন শারীয়াহ দ্বারা বিচার করে ও শাসনকার্য চালায়, যা রহিত হয়ে গেছে, তবে সে কাফির হয়ে গেছে। তবে (চিন্তা করুন) সেই ব্যক্তির অবস্থা কি রূপ যে আল-ইয়াসিক্বের ভিত্তিতে শাসন করে এবং একে ইসলামী শারীয়াহ’র উপর স্থান দেয়? এরকম যেই করবে সে মুসলিমদের ইজমা অনুযায়ী কাফির।“ [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ত্রয়োদশ খন্ড, পৃষ্ঠা ১১৯]
.
দেখা যাচ্ছে ইসলামি এবং গণতান্ত্রিক উভয় অবস্থান থেকেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে এই দুই আদর্শের সহাবস্থান সম্ভব না। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা সম্ভন না কারণ ইসলাম সংবিধানের সার্বভৌমত্ব মানে না। এবং গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র এটা মেনে নেবে না। যতক্ষণ মুসলিমরা সংবিধানের সার্বভৌমত্ব না মানার ব্যাপারে চুপ থাকবে ততোক্ষণ হয়তো বা তারা নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলতে পারবে, কিন্তু যখনই তারা ইমানকে আমলে – বিশ্বাসকে কাজে – পরিণত করতে যাবে বা কাজে পরিণত করার দাবি জানাবে তখনই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কঠোরভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে। যদি এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকে তাহলে শাপলা চত্বরের ঘটনাই প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।
.
একইভাবে ইসলাম কখনই কুরআন ছাড়া আর কোন সংবিধানকে মানবে না এবং মালিকুল মুলক আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ছাড়া আর কারো সার্বভৌমত্ব স্বীকার করবে না। কারণ যদি তা স্বীকার করা হয়, তখন সেটা আর ইসলাম থাকে না, তা কুফর ও শিরকে পরিণত হয়। গণতন্ত্রে বিশ্বাস আলটিমেটলি শর্ত দেয় কুর’আন ও শারীয়াহকে অস্বীকার করার। তাহলে এদুটো ব্যাবস্থা কিভাবে কো-এক্সিস্ট করতে পারে, ব্যক্তির চিন্তা ও চেতনায়, কিম্বা রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে? না গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আর না ইসলামের অবস্থান থেকে, কোন ভাবেই এই দুই ধর্মের সহাবস্থান সম্ভব না।
.
যদি কেউ দাবি করে, সে গণতন্ত্রকে পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করছে মাত্র, কিন্তু এতে বিশ্বাস স্থাপন করছে না, বা এতে ইমান আনছে না – তার এই অবস্থান ইসলামি বা গণতান্ত্রিক কোন দিক থেকেই গ্রহণযোগ্য না। তাত্ত্বিকভাবে এবং প্রায়োগিকভাবে গণতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। যতোই কেউ দাবি করুক না কেন যে, সে গণতন্ত্রকে ক্ষমতায় যাবার জন্য বা মুসলিমের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করছেন, সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ গণতন্ত্রে আমাকে ঢুকতেই হচ্ছে সংবিধান ও জনগণের সার্বভৌমত্ব মেনে। মুসলিমের কল্যাণের জন্য ফসলের জন্য যেমন দুর্গার কাছে কিছু চাওয়া যাবে না, দুর্গার প্রশংসা করা যাবে না, ঠিক একই ভাবে গণতন্ত্রের এই মূলনীতিও মানা যাবে না। কারণ এটা সরাসরি তাওহীদে বিশ্বাসের সাথে ব্যাপকভাবে সাংঘর্ষিক। আর তাওহীদের ব্যাপারে কম্প্রোমাইস করলে ঈমানের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
.
গণতন্ত্রের এবং ইসলামের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে আলোচনা করার মতো আরো অনেক দিক আছে। বিশেষ করে, গণতন্ত্রের একটি শিরকি ও কুফরি মতবাদ হবার ব্যাপারে, এবং কথিত “ইসলামি” গণতন্ত্রে ব্যাপারে উপমহাদেশের অনেক সম্মানিত আলিমদের মত তুলে ধরা হয়েছে।
লিংকঃ http://bit.do/Democracy-Akabir
.
আপাতত এখানে শেষ করতে হচ্ছে। শেষ করার আগে সালমান আল ফারসি (রা:) সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিস তুলে ধরছি, যা আমার কাছে এই আলোচনার জন্য খুব অ্যাপ্রোপ্রিয়েট মনে হয়েছে। হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে মুসনাদে আহমাদের, এছাড়া আল বায়হাক্বী এবং ইবনু আবি শায়বাহও হাদিসটি বর্ণনা করেছেন [আলবানীর মতে মারফু সূত্রে এটির সনদ দ্বাইফ, মাওকুফ সুত্রে এর সনদ সাহীহ – সিলসিলা আদ্ব-দ্বাইফা]
.
“রাসূল ﷺ বলেন, এক ব্যক্তি একটি মাছির কারণে জান্নাতে যাবে আর এক ব্যক্তি একটি মাছির কারণে জাহান্নামে যাবে। সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া ইজমাইন গণ বললেন তা কিভাবে?
.
উত্তরে রাসূল ﷺ বললেন: এক কওমের একটি ভাষ্কর্য বা মূর্তি ছিল। ওটার পাশ দিয়ে যেই যেত সেই উক্ত ভাষ্কর্যে কোন কিছু উৎসর্গ না করে যেতে পারতো না। সেখান দিয়ে একবার দু’জন লোক যাচ্ছিল। তাদের একজনকে মূর্তিওয়ালারা বলল কিছু দান করে যাও। সে বলল, আমার কাছে দান করার মত কোন কিছুই নেই। তারা বলল একটি মাছি হলেও তোমাকে উৎসর্গ করতে হবে। সুতরাং সে একটি মাছি উৎসর্গ করল। তারা তার পথ ছেড়ে দিল। এভাবে সে জাহান্নামে প্রবেশের ফায়সালা নিশ্চিত করল।
.
এবার অপরজনকেও বলল: কিছু দান করে যাও। সে জবাবে বলল, আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে কোন কিছুই দান করব না। ফলে তারা তরবারী দিয়ে তার গর্দান উড়িয়ে দিল। কিন্তু সে জান্নাতের ফয়সালা লাভ করল।”
.
.
ব্লগ থেকে পড়ুনঃ https://pursuitoftruthsite.wordpress.com
.
No comments:
Post a Comment