মীলাদুন্নবী সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মতামত: একটি সংশয় নিরসন
_________________
মীলাদুন্নবী সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর মতামত কি -- এ বিষয়ে সৌদী আরবের প্রসিদ্ধ আলেম শায়খ শরীফ হাতিম আল-আওনী (হাফি.) এর একটি লেখা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এই লেখাটির উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু ভাইকে দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় ইবনে তাইমিয়ার নামে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এর দায় অবশ্য শায়খ হাতিম আল-আওনীর ওই লেখার উপর বেশী বর্তায়। এদেশের যারা এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন তাদের সমস্যা হচ্ছে, তারা ইবনে তাইমিয়ার মূল কিতাবাদি পড়ে তাঁর মতামত না জেনে একজন শায়খের উদ্ধৃতির উপর ভরসা করেছেন।
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে ভূমিকাস্বরুপ একটি কথা বলতে চাই। আরবী পরিভাষায় 'তাজযিয়াতুন নুসুস' বলে একটি কথা আছে। এর অর্থ হচ্ছে, কারো কোন বক্তব্যকে কাটছাঁট করে নিজের পছন্দমতো স্থান উল্লেখ করা। এটা যে সবসময় ইচ্ছেকৃতভাবে এবং অসৎ উদ্দেশ্যে হয় সেটা নয়। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, উক্ত বিষয়ে ব্যাক্তিটির অপর্যাপ্ত জানাশোনা দায়ী থাকে। সব রেফারেন্স ঘেঁটে কোন বিষয়ে কারো পূর্নাঙ্গ বক্তব্য দাঁড় করাতে তিনি সক্ষম হননি। ফলে কারো নির্দিষ্ট একটি কথা কোট করে তার উপর একটি হুকুম লাগিয়ে দেন। এভাবেই বিভ্রান্তি ছড়ায়। আবার কেউ কাজটা অসৎ উদ্দেশ্যেও করে থাকে। ইচ্ছে করে কারো খন্ডিত বক্তব্য উল্লেখ করে তার সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা প্রচার করে।
এই ব্যাপারটা কেবল কোন ইমাম কিংবা আলিমের ক্ষেত্রেই নয়; বরং কোরআন এবং হাদীসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোরআন এবং হাদীসের এমন কিছু উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, যেগুলোকে খালি চোখে দেখলে পরষ্পর বিরোধী মনে হয়। এসব ক্ষেত্রে বৈপরীত্যটা কেবল বাহ্যিকভাবে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে কোন বৈপরীত্য থাকে না। কোরআন এবং হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণ দলিল প্রমানের ভিত্তিতে বিশদ আলোচনার মাধ্যমে এগুলোর মধ্যে বিভিন্নভাবে সামঞ্জস্য বিধান করে থাকেন। এ বিষয়ে 'মুখতালাফুল হাদীস' নামে আলাদা একটি শাস্ত্রেরও গোড়াপত্তন করা হয়েছে এবং এই বিষয়ে প্রচুর কিতাবাদিও লেখা হয়েছে। এখন কেউ যদি এই ধরণের কোন বিষয়ে নির্দিষ্ট একটি বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে সেটাকে ইসলামের অবস্থানরুপে দেখাতে চায় তাহলে সেটা নিশ্চিতভাবেই ভুল কাজ হবে।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। শায়খ শরীফ হাতিম আল-আওনী আমার উস্তাদ। নিয়মতি উস্তাদ না, তবে তাঁর দরসে বসার সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আমার কথাও হয়েছে। একটি সেলফীও তোলা আছে। কেউ চাইলে মেসেঞ্জারে দেবো। ইলমে হাদীস বিষয়ে তাঁর কিতাবাদিকে আমি গুরুত্বের সাথে পড়ি। তিনি আমাদের শায়খ, খাতিমাতুল মুহাদ্দিসীন, ডক্টর আহমাদ মা'বাদ আব্দুল কারীমের ছাত্র। ডক্টর আহমাদ মা'বাদ শায়খ হাতিম আল-আওনীকে পছন্দও করেন। আযহারের হাদীসী সেমিনারগুলোতে তাঁকে নিয়মিত দাওয়াত দেন।
এই কথাগুলো বলার কারণ হচ্ছে, শায়খ হাতিম আল-আওনীর ব্যাপারে আমার জানাশোনা এবং তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার ব্যাপারটা বোঝানো।
শায়খ শরীফ হাতিমের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে, তিনি ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মীলাদ সংক্রান্ত উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়ার পূর্নাঙ্গ বক্তব্য উল্লেখ করেন নি। এ বিষয়ে ইবনে তাইমিয়ার মূল ফতওয়া কি সেটাও উল্লেখ করেন নি। যে অংশটি উল্লেখ করেছেন সেটাকেও এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, এর কারণে পাঠকের মনে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। তিনি যে অর্থে ইবনে তাইমিয়ার কথাটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন সে অর্থে ইবনে তাইমিয়া রহ. কথাটি বলেছেন -- এমনটাও প্রমাণিত হয় না। বিষয়টা সামনের আলোচনায় স্পষ্ট হবে।
মীলাদুন্নবী সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মূল ফতোয়া কি?
প্রচলিত মীলাদ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ফতোয়া হচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ বিদআত। তাঁকে মাওলিদের রাত সম্পর্কে মাসআলা জিজ্ঞাসা করে হলে তিনি বলেছিলেন:
ﻭَﺃَﻣَّﺎ ﺍﺗِّﺨَﺎﺫُ ﻣَﻮْﺳِﻢٍ ﻏَﻴْﺮِ ﺍﻟْﻤَﻮَﺍﺳِﻢِ ﺍﻟﺸَّﺮْﻋِﻴَّﺔِ ﻛَﺒَﻌْﺾِ ﻟَﻴَﺎﻟِﻲ ﺷَﻬْﺮِ ﺭَﺑِﻴﻊٍ ﺍﻟْﺄَﻭَّﻝِ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﻳُﻘَﺎﻝُ : ﺇﻧَّﻬَﺎ ﻟَﻴْﻠَﺔُ ﺍﻟْﻤَﻮْﻟِﺪِ ﺃَﻭْ ﺑَﻌْﺾِ ﻟَﻴَﺎﻟِﻲِ ﺭَﺟَﺐٍ ﺃَﻭْ ﺛَﺎﻣِﻦَ ﻋَﺸَﺮَ ﺫِﻱ ﺍﻟْﺤِﺠَّﺔِ ﺃَﻭْ ﺃَﻭَّﻝِ ﺟُﻤْﻌَﺔٍ ﻣِﻦْ ﺭَﺟَﺐٍ ﺃَﻭْ ﺛَﺎﻣِﻦِ ﺷَﻮَّﺍﻝٍ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻳُﺴَﻤِّﻴﻪِ ﺍﻟْﺠُﻬَّﺎﻝُ ﻋِﻴﺪَ ﺍﻟْﺄَﺑْﺮَﺍﺭِ ﻓَﺈِﻧَّﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﺍﻟْﺒِﺪَﻉِ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﻟَﻢْ ﻳَﺴْﺘَﺤِﺒَّﻬَﺎ ﺍﻟﺴَّﻠَﻒُ ﻭَﻟَﻢْ ﻳَﻔْﻌَﻠُﻮﻫَﺎ ﻭَﺍَﻟﻠَّﻪُ ﺳُﺒْﺤَﺎﻧَﻪُ ﻭَﺗَﻌَﺎﻟَﻰ ﺃَﻋْﻠَﻢُ .
অর্থাৎ, "শরীয়তের বৈধ দিবস ছাড়া অন্যকোন দিবস যেমন, রবিউল আওয়ালের যে রাতকে 'লাইলাতুল মাওলিদ' বলা হয়, এভাবে রজব মাসের নির্দিষ্ট কোন রাত, জুলহজ্জ মাসের ১৮ তারিখের রাত, রজব মাসের প্রথম জুমার দিন এবং শাওয়াল মাসের দিন যেটাকে অজ্ঞ লোকেরা 'ঈদুল আবরার' বলে -- এগুলো সবই এমন সব বিদআত কর্মকান্ড যেগুলোকে আমাদের সালাফগণ পছন্দ করেন নি এবং পালনও করেন নি। আল্লাহ সর্বজ্ঞানী।" (১)
শায়খ শরীফ হাতিম ইবনে তাইমিয়ার কিতাব 'ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম'-এর যে জায়গাটার উদ্ধৃতি দিয়েছেন তার ৩ পৃষ্ঠা পূর্বে ইবনে তাইমিয়া রহ. লিখেছেন:
ﻓﺈﻥ ﻫﺬﺍ ﻟﻢ ﻳﻔﻌﻠﻪ ﺍﻟﺴﻠﻒ، ﻣﻊ ﻗﻴﺎﻡ ﺍﻟﻤﻘﺘﻀﻲ ﻟﻪ ﻭﻋﺪﻡ ﺍﻟﻤﺎﻧﻊ ﻣﻨﻪ ﻟﻮ ﻛﺎﻥ ﺧﻴﺮًﺍ . ﻭﻟﻮ ﻛﺎﻥ ﻫﺬﺍ ﺧﻴﺮًﺍ ﻣﺤﻀﺎ، ﺃﻭ ﺭﺍﺟﺤًﺎ ﻟﻜﺎﻥ ﺍﻟﺴﻠﻒ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻢ ﺃﺣﻖ ﺑﻪ ﻣﻨﺎ، ﻓﺈﻧﻬﻢ ﻛﺎﻧﻮﺍ ﺃﺷﺪ ﻣﺤﺒﺔ ﻟﺮﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻭﺗﻌﻈﻴﻤًﺎ ﻟﻪ ﻣﻨﺎ، ﻭﻫﻢ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺨﻴﺮ ﺃﺣﺮﺹ .
"এই কাজটা (মওলিদ উদযাপন) সালাফ আলেমদের কেউই করেন নি, এই কাজের প্রতি উৎসাহব্যাঞ্জক কারণ ( ﻣﻘﺘﻀﻲ ) থাকা সত্ত্বেও এবং এর বিরুদ্ধে কোন বাধা (ﻣﺎﻧﻊ) না থাকা সত্ত্বেও। যদি এই কাজটার কল্যানকর হতো অথবা উচিত হতো তাহলে পূর্ববর্তী আলেমগণ এর বেশী হক্বদার ছিলেন। কারণ তারা আমাদের চেয়েও বেশী নবী-প্রেমিক ছিলেন। রাসুলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও তারা এগিয়েছিলেন এবং উত্তম কাজের ব্যাপারে তারা অধিক সচেতন ছিলেন।" (২)
এর থেকে পষ্ট হয় যে, ইবনে তাইমিয়া রাহ. মীলাদ সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠানকে স্পষ্ট বিদআত মনে করতেন এবং এর থেকে মুসলমানদেরকে সতর্ক করেছেন।
এছাড়াও ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. যাবতীয় নবআবিষ্কৃত ঈদ, দিবস এবং ইসলাম সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সাধারণ ফতওয়া প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন:
ﺳﺎﺋﺮ ﺍﻷﻋﻴﺎﺩ ﻭﺍﻟﻤﻮﺍﺳﻢ ﺍﻟﻤﺒﺘﺪﻋﺔ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﻨﻜﺮﺍﺕ ﺍﻟﻤﻜﺮﻭﻫﺎﺕ ﺳﻮﺍﺀ ﺑﻠﻐﺖ ﺍﻟﻜﺮﺍﻫﺔ ﺍﻟﺘﺤﺮﻳﻢ ﺃﻭ ﻟﻢ ﺗﺒﻠﻐﻪ .
অর্থাৎ, "যাবতীয় নবআবিষ্কৃত ঈদ এবং দিবস (ইসলাম সংক্রান্ত অনুষ্ঠান) নিন্দনীয়, পরিত্যজ্য এবং মাকরুহের অন্তর্ভুক্ত। মাকরুহের স্তরটা হারামের পর্যায়ে পৌঁছুক বা না পৌঁছুক।"(৩)
তিনি অন্যত্র লিখেছেন:
ﻣﺎ ﺃﺣﺪﺙ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﻮﺍﺳﻢ ﻭﺍﻷﻋﻴﺎﺩ ﻓﻬﻮ ﻣﻨﻜﺮ ﻭﺇﻥ ﻟﻢ ﻳﻜﻦ ﻓﻴﻪ ﻣﺸﺎﺑﻬﺔ ﻷﻫﻞ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ .
অর্থাৎ, নবআবিষ্কৃত ঈদ এবং দিবসসমূহ মুনকার (পরিত্যজ্য), যদিও সেগুলো আহলে কিতাবের অনুষ্ঠানের সাথে সাদৃশ্য না হয়।(৪)
পূর্বে উল্লেখিত ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মিলাদ সংক্রান্ত ফতওয়াগুলোর সাথে পরের দুটি সাধারণ ফতওয়াকে মিলিয়ে দেখলে এ বিষয়টি আরও পষ্ট হয় যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. এর সঠিক অবস্থান হচ্ছে, তিনি মীলাদুন্নবির যাবতীয় রুপকে বিদআত মনে করতেন।
শায়খ শরীফ হাতিম আল-আওনীর দাবী:
এবার শায়খ হাতিম আল-আওনী ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর যে কথাটার উদ্ধৃতি দিয়েছেন সেটা দেখা যাক। তিনি বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে মীলাদকে জায়েয প্রমান করতে গিয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. সম্পর্কে লিখেছেন:
ﺑﻞ ﻫﺬﺍ ﺷﻴﺦ ﺍﻹﺳﻼﻡ ﺍﺑﻦ ﺗﻴﻤﻴﺔ ﻓﻲ ﻛﺘﺎﺑﻪ ( ﺍﻗﺘﻀﺎﺀ ﺍﻟﺼﺮﺍﻁ ﺍﻟﻤﺴﺘﻘﻴﻢ ) ، ﻣﻊ ﺣﻜﻤﻪ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻤﻮﻟﺪ ﺑﺄﻧﻪ ﺑﺪﻋﺔ؛ ﺇﻻ ﺃﻧﻪ ﻋﺬﺭ ﻣﻘﻴﻤﻴﻪ، ﺑﻞ ﺍﻋﺘﻘﺪ ﺣﺼﻮﻝ ﺍﻷﺟﺮ ﺍﻟﻌﻈﻴﻢ ﻟﻬﻢ ﻓﻴﻪ، ﻓﻘﺎﻝ ( ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ ) : ( ﻓﺘﻌﻈﻴﻢ ﺍﻟﻤﻮﻟﺪ، ﻭﺍﺗﺨﺎﺫﻩ ﻣﻮﺳﻤﺎ، ﻗﺪ ﻳﻔﻌﻠﻪ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻨﺎﺱ، ﻭﻳﻜﻮﻥ ﻟﻪ ﻓﻴﻪ ﺃﺟﺮ ﻋﻈﻴﻢ؛ ﻟﺤﺴﻦ ﻗﺼﺪﻩ، ﻭﺗﻌﻈﻴﻤﻪ ﻟﺮﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ . ﻛﻤﺎ ﻗﺪﻣﺘﻪ ﻟﻚ : ﺃﻧﻪ ﻗﺪ ﻳﺤﺴﻦ ﻣﻦ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻨﺎﺱ، ﻣﺎ ﻳﺴﺘﻘﺒﺢ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺆﻣﻦ ﺍﻟﻤﺴﺪﺩ ).
অর্থাৎ, "... বরং শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া স্বীয় কিতাব 'ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীমে' মীলাদকে বিদআত বলা সত্ত্বেও মীলাদ পালনকারীদেরকে মা'যুর সাব্যস্ত করেছেন (অর্থাৎ, তাদেরকে মন্দ ভাবেন নি)। শুধু তাই নয়; মীলাদ পালন করার কারণে তাদের অনেক বড় সওয়াব হাসিল হবে বলেও মনে করেছেন। তিনি (ইবনে তাইমিয়া) বলেছেন: "মীলাদকে সম্মান করা এবং এটাকে নির্দিষ্ট দিবস বানানো -- এই কাজটা অনেকে করে থাকে। তার নেক নিয়্যাত এবং রাসূলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কারণে এই কাজের জন্য সে সওয়াবও পাবে। যেমনটা আমি পূর্বেও বলে এসেছি যে, সাধারণ মুসলমানের এমন কিছু কিছু কাজকে মেনে নেয়া হয়, যেগুলো পোক্ত মুমিনের ক্ষেত্রে নিন্দনীয় হিসেবে ধরা হয়।"(৫)
শায়খ হাতিম আল-আওনী এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর বলা "নেক নিয়্যাত এবং রাসূলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কারণে সে সওয়াবও পাবে" -- এই কথাটির উপর ফোকাস করেছেন। এর ভিত্তিতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. সামগ্রীকভাবে মীলাদকে মন্দ ভাবতেন না।
এই উদ্ধৃতিটি ছাড়া ইবনে তাইমিয়ার আর কোন বক্তব্য তিনি উল্লেখ করেন নি। মূলত: ইবনে তাইমিয়ার এ ধরণের আরো ২টি বক্তব্য পাওয়া যায়, যেগুলোকে সরল চোখে দেখলে মনে হবে যে, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. মীলাদ পালনকরাকে সওয়াবের কাজ মনে করতেন।
১ম উদ্ধৃতি: ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন:
ﻭﻛﺬﻟﻚ ﻣﺎ ﻳﺤﺪﺛﻪ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻨﺎﺱ، ﺇﻣﺎ ﻣﻀﺎﻫﺎﺓ ﻟﻠﻨﺼﺎﺭﻯ ﻓﻲ ﻣﻴﻼﺩ ﻋﻴﺴﻰ ﻋﻠﻴﻪ ﺍﻟﺴﻼﻡ، ﻭﺇﻣﺎ ﻣﺤﺒﺔ ﻟﻠﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ، ﻭﺗﻌﻈﻴﻤًﺎ . ﻭﺍﻟﻠﻪ ﻗﺪ ﻳﺜﻴﺒﻬﻢ ﻋﻠﻰ ﻫﺬﻩ ﺍﻟﻤﺤﺒﺔ ﻭﺍﻻﺟﺘﻬﺎﺩ، ﻻ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺒﺪﻉ - ﻣﻦ ﺍﺗﺨﺎﺫ ﻣﻮﻟﺪ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻋﻴﺪًﺍ .
অর্থাৎ, "অনুরুপভাবে, খ্রীষ্টানরা যেমন হযরত ঈসা (আ) এর জন্মানুষ্ঠান পালন করে তেমনি তাদেরকে অনুসরণ করতে গিয়ে অথবা নবীজীর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে কেউ কেউ মীলাদ সংক্রান্ত যেসব বিষয় আবিষ্কার করে, সেগুলোর ক্ষেত্রে আল্লাহ তাদেরকে সওয়াব দান করবেন, তাদের মুহাব্বাত এবং পরিশ্রমের কারণে, বিদআতের কারণে নয়।"(৬)
২য় উদ্ধৃতি: তিনি বলেছেন:
ﻭﺃﻛﺜﺮ ﻫﺆﻻﺀ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﺗﺠﺪﻫﻢ ﺣﺮﺍﺻًﺎ ﻋﻠﻰ ﺃﻣﺜﺎﻝ ﻫﺬﻩ ﺍﻟﺒﺪﻉ، ﻣﻊ ﻣﺎ ﻟﻬﻢ ﻣﻦ ﺣﺴﻦ ﺍﻟﻘﺼﺪ، ﻭﺍﻻﺟﺘﻬﺎﺩ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﻳﺮﺟﻰ ﻟﻬﻢ ﺑﻬﻤﺎ ﺍﻟﻤﺜﻮﺑﺔ ...
অর্থাৎ, "...এদের অধিকাংশ লোক, যাদেরকে এসব বিদআতের প্রতি গুরুত্বশীল হতে দেখো, যারা তাদের নেক নিয়্যাত এবং পরিশ্রমের কারণে সওয়াব পাবে বলে আশা করা যায়..."(৭)
উপরোল্লেখিত ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর ৩টি উদ্ধৃতিতে যে বিষয়টি কমন পাওয়া যাচ্ছে সেটা হলো: তিনি মীলাদ পালনকারীদের জন্য দু'টি ওজর তালাশ করেছেন -- নবী-প্রেম ও পরিশ্রম, এবং তাদের সওয়াব প্রাপ্তির ব্যাপারে আশা ব্যাক্ত করেছেন। এর থেকে শায়খ হাতিম আল-আওনী'সহ কেউ কেউ ধরে নিয়েছেন যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. মীলাদ উদযাপন করাকে মন্দ ভাবেন নি। বরং শর্তসাপেক্ষে জায়েয মনে করতেন।
তাহলেতো এই মতটি পূর্বে উল্লেখিত তাঁর ফতোয়ার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে গেল! এর সমাধান কী হবে?
মূলত: আমরা যদি এই ৩টি উদ্ধৃতিকে সেগুলোর আগের এবং পরের ইবারতের সাথে মিলিয়ে দেখি তাহলেও এই সংশয় থাকার অবকাশ থাকে না যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. মীলাদের ব্যাপারে কোন রকম শীতিলতা প্রদর্শন করেছিলেন।
০১ নং উদ্ধৃতির উপর পর্যালোচনা:
এটা শায়খ হাতিম আল-আওনী উল্লেখ করেছেন। এই কথাটি ইবনে তাইমিয়া রহ. মুসলমানদের আমলের প্রকার উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন। তিনি আমলকে ৩ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: ১. সর্বদিক দিয়ে নেক এবং জায়েয আমল, যেটাতে কোন রকমের কারাহাত বা নিন্দনীয় কিছু নেই। ২. ভালো এবং খারাপের মিশ্রিত আমল। যেগুলোতে নিয়্যাত বা অন্যকোন জায়েয কর্মের কারণে ভালো দিকও যেমন আছে, অনুরুপ অন্য হিসেবে দিয়ে খারাপ দিকও আছে। ৩. যেগুলো সর্বদিক দিয়ে মন্দ কাজ। ইবনে তাইমিয়া রহ. ২য় প্রকারের উদাহরণ দিতে গিয়ে মীলাদের কথা উল্লেখ করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি এই প্রকারের মধ্যে ( ﺻﻮﻡ ﻭﺻﺎﻝ) বা লাগাতার নফল রোজা রাখা, বৈধ যৌনকর্ম ত্যাগ করা, কোন কোন রাতকে নির্দিষ্ট করে ইবাদত করা, যেমন রজব মাসের প্রথম রাত ইত্যাদি। এর সবগুলোর মধ্যে কিছু ভালো দিক আছে আবার কিছু মন্দ দিক আছে। মীলাদের রাতে এবং রজব মাসের প্রথম রাতে নামাজ, দোয়া দরুদ পড়া, যৌনতা এবং নফসের খাহেশাত থেকে দূরে থাকা, রোজা রাখা -- এসব হচ্ছে ভালো দিক। কিন্তু এগুলোর প্রত্যেকটিতেই মন্দ দিক আছে। মীলাদের রাত বা রজবের রাতের ইবাদতের মন্দ দিক হচ্ছে, এসব দিবসকে উদযাপন করা এবং এই উপলক্ষে বিশেষ ইবাদতের প্রচলন করা বিদআত। নবীজী, সাহাবীগণ এবং সালাফের কোন আলেমগণ এসব কষ্মিনকালেও করেন নি। এভাবে 'সওমে ওয়েসাল' বা লাগাতার নফল রোজা রাখার মধ্যে রোজা জিনিসটাতো নেক আমল, কিন্তু সেটাকে এভাবে বিরতিহীনভাবে রাখাটা মাকরুহ এবং সুন্নাত পরিপন্থি। এধরণের কাজগুলোর ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন যে, যদি দ্বীনের ব্যাপারে সাধারণত উদাসীন থাকে এমন কোন সাধারণ মুসলমান যদি এই কাজগুলো করে ফেলে তাহলে সে তার 'নেক নিয়্যাতের' কারণে সওয়াব পাবে। দেখুন তাইমিয়া বলেছেন যে, সে ব্যাক্তি তার নিয়্যাতের কারণে সওয়াব পাবে। কিন্তু তাই বলে কাজটা বৈধ হয়ে যাবে না। বরং সেটা অবৈধই থাকবে। যেমন 'বিরতিহীনভাবে নফল রোজা রাখা' তার জন্য বৈধ হয়ে যায়নি। বৈধ স্ত্রী সঙ্গম ত্যাগ করা তার জন্য জায়েজ হয়ে যায়নি। অনুরুপভাবে সে বিদআতের বিষয়টি না জেনে যদি রবিউল আওয়াল মাসে মীলাদ উপলক্ষে নামাজ, সদকাহ ইত্যাদি কোন নেক আমল করে তাহলে সে তার নেক নিয়্যাতের কারণে সওয়াব পাবে। কারণ সে বিদআতের হুকুমটি জানে না। কিন্তু তাই বলে মীলাদ পালনকরাটা বৈধ হয়ে যাবে না, সেটা বিদআতই থাকবে। এর একটি উদাহরণও তিনি দিয়েছেন। ইমাম আহমাদ ইবনে হান্বাল (রহ) এর মাযহাব হচ্ছে কোরআন শরীফকে বিভিন্ন কারুকার্যময় করে সাজানো মাকরুহ। একদিন এক লোক এসে তাঁকে বললো: অমুক আমির তার কোরআনকে সজ্জিত করার পেছনে ১ হাজার দীনার ব্যায় করেছে। এটা শুনে ইমাম আহমাদ বললেন: "তাদেরকে ছেড়ে দাও। এটা তাদের স্বর্ণমুদ্রা ব্যায় করার জন্য ভালো জায়গা।" নতুবা তারা নর্তকিদের পেছনে গোনাহের কাজে সেগুলো ব্যায় করতো। ইমাম আহমাদের এই কথার অর্থ এই নয় যে, কোরআনকে স্বর্ণ-রুপা দিয়ে সজ্জিত করা বৈধ। বরং তিনি বিশেষ ব্যাক্তির ক্ষেত্রে তার বিশেষ পরিস্থিতির কারণে বলেছেন যে, তাকে ছেড়ে দাও। তাঁর নিকট কোরআনকে সজ্জিত করা মাকরুহ হওয়া'র মাসআলাটি অপরিবর্তিতই থাকবে। শায়খ হাতিম আল-আওনী ইবনে তাইমিযার যে ইবারতটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন তার পরের ৩টি পৃষ্ঠা দেখলে এই কথাগুলো পষ্ট হয়ে যায়।(৮)
০২ নং উদ্ধৃতির পর্যালোচনা:
এই উদ্ধৃতির ক্ষেত্রেও একই কথা। এই ইবারতের উপরের ৫টি লাইনের উপর দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন:
"এই দিনটিকে (গদীরে খামের দিন) ঈদ হিসেবে পালন করা নবআবিষ্কৃত কাজ, যার কোন শরয়ী ভিত্তি নেই। সালাফের মধ্যে এবং আহলে বাইতের মধ্যে এমন কোনও ব্যাক্তি নেই যে এই দিনটিকে বিশেষ আমলের জন্য ঈদ হিসেবে উদযাপন করেছে। কারণ ঈদ হচ্ছে একটি শরীয়তের বিধান। অতএব, এ ক্ষেত্রে শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণ করতে হবে। কোনভাবেই ইচ্ছে মতো নতুন কিছু আবিষ্কার করা যাবে না। ...... এরকম কাজগুলো মূলত ইহুদী এবং খ্রীষ্টানরা করে থাকে। খ্রীষ্টানরা যেমন হযরত ঈসা (আ) এর বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান পালন করে। বস্তুত ঈদ হচ্ছে শরয়ী বিধান। আল্লাহ শরীয়ত হিসেবে যেটা বৈধ করেছেন সেটা অনুকরণীয় হবে।"
এতটুকু বলার পরে তিনি বলেছেন:
"অনুরুপভাবে যারা খ্রীষ্টানদের অনুসরণ করে অথবা নবী-প্রেমের কারণে রাসূলুল্লাহ (স) এর নামেও এরকম কিছু করে থাকে তাহলে সে নেক নিয়্যাতের কারণে তো সওয়াব পাবে, কিন্তু তা কোনভাবেই তার বিদআত কর্মের কারণে নয়। তাছাড়া, মওলিদের তারিখ নিয়েতো এমনিতেই মতভিন্নতা আছে।"
এরপর তিনি বলেছেন:
"এই কাজটি পূর্ববর্তী আলেমদের মধ্যে কেউ করেন নি। (ﻣﻘﺘﻀﻲ ) থাকা সত্ত্বেও এবং ( ﻣﺎﻧﻊ) না থাকা সত্ত্বেও। যদি এটা নেক কাজ হতো তাহলে সালফগণই এই কাজের বেশী হকদার ছিলেন। কারণ তারা আমাদের চেয়েও নবীজীকে বেশী ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন।"(৯)
ইবনেই তাইমিয়া রহ. এর এই বক্তব্যের মধ্যে ৩ টি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ:
১. তিনি মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠানকে শীয়াদের অনুষ্ঠান 'গাদীরে খাম' এবং খ্রীষ্টানদের ক্রীষ্টমাসের সাথে তুলনা করে একই ক্যাটাগরীতে উল্লেখ করেছেন। অতএব, গদীরে খাম যদি না-জায়েয অনুষ্ঠান হয় তাহলে মীলাদুন্নবীকে ইবনে তাইমিয়া কিভাবে জায়েয মনে করবেন?
২. তিনি এগুলোকে 'ঈদ' (অর্থৎ 'অনুষ্ঠানের দিন') শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করছেন। বর্তমানে যেমন 'ঈদে মীলাদুন্নবী' বলা হয়। তারপর তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, ঈদ 'তাওকীফী' বিষয়। এটা শরীয়তের একটি বিধান। শরীয়তে যে দিনগুলোকে বিশেষভাবে পালন করার বিধান রাখা হয়েছে সেগুলোকেই কেবল 'ঈদ' বা বিশেষ দিন হিসেবে পালন করা যাবে। খেয়ালখুশী মতো নতুন কিছু আবিষ্কার করা যাবে না।
৩. নবীজী, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তবেতাবেয়ীন এবং সালফে সালেহীনের মধ্যে কেউ কাজটি করে নি। মুক্তাদী (ﻣﻘﺘﻀﻲ ) থাকা সত্ত্বেও এবং মানে' (ﻣﺎﻧﻊ) না থাকা সত্ত্বেও। অর্থাৎ, রাসূলের জন্মকে কেন্দ্র করে কোন বিশেষ কিছু পালন করা যদি নেক কাজ হতো তাহলে অবশ্যই তার বিধান রাসূলের যুগেই নাযিল হতো। নবীজী এবং সাহাবীগণ সেটা পালন করতেন। যেমন আশুরার রোজার বিধান এসেছে। কারণ আল্লাহ দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। কোন হুকুম বাদ রাখেন নি। এটা যদি দ্বীন হতো তাহলে তার তাকাজা বা দাবী হচ্ছে এই ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম নাযিল হওয়া। দ্বিতীয়ত কোন (ﻣﺎﻧﻊ) বা বাধাও ছিলো না।
এই ৩ নং পয়েন্টটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. বিদআতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্তের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। বিদআত বলা হয় নবী-যুগ এবং সাহাবী-যুগের পরবর্তী সময়ে এমন নতুন কিছু আবিষ্কার করা যেটা ( ﻣﻘﺘﻀﻲ ) থাকা সত্ত্বেও এবং কোন রকম ( ﻣﺎﻧﻊ) না-থাকা সত্ত্বেও নবীজী এবং সাহাবায়ে কেরাম করেন নি এবং কোরআন-হাদীসে যার কোন (ﺃﺻﻞ ) বা ভিত্তি পাওয়া যায় না। এটা বিদআতের নিখুঁত সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞাটিকে ইবনে তাইমিয়া রহ. মীলাদুন্নবীর উপর প্রয়োগ করেছেন। তারপরেও কি বলা হবে যে, ইবনে তাইমিয়্যা মীলাদকে সামগ্রীকভাবে বিদআত মনে করতেন না?!
০৩ নং উদ্ধৃতির পর্যালোচনা:
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর এই বক্তব্যটা আরো বেশী স্পষ্ট। এই ইবারতটাকেও যদি আমরা তার পূর্বের এবং পরের কিছু ইবারতসহ পাঠ করি তাহলে দেখতে পাবো যে তিনি বলেছেন: "রাসূলের প্রকৃত ভালোবাসা হচ্ছে তার অনুসরণ-অনুকরণ করা, তার সুন্নাতকে ভেতরে বাইরে জিন্দা করা এবং এর পেছনে নিজের অন্তর, হাত এবং জবান দ্বারা সর্বাত্মক শ্রম ব্যায় করা। এটাই সকল সাহাবী এবং তাঁদের অনুসারীদের তরীকা। আর ঐ সকল লোক যাদেরকে তোমরা এ ধরণের বিদআত কর্মকান্ডের প্রতি বেশী আগ্রহী হতে দেখো -- যদিও তারা নেক নিয়্যাত এবং শ্রমের বদৌলতে সওয়াব পাবে বলে আশা করা যায় -- তাদেরকে তোমরা দেখবে যে, তারা নবীজী যেসকল কাজের নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলো থেকে পলায়ন করে। এরা ঐসকল মানুষের মতো, যারা কোরআনকে বিভিন্নভাবে সজ্জিত করে রাখে, কিন্তু কোরআন পড়ে না। অথবা পড়ে, কিন্তু আমল করে না। এবং তাদের মতো যারা মসজিদে কারুকার্য করে ঠিকই, কিন্তু সেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে না।"(১০)
এই পূর্ণাঙ্গ ইবারতটি পড়ার পর কারো এরকম সংশয় জাগার কথা নয় যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে মীলাদের কোন প্রকারকে জায়েয দেখাতে চেয়েছেন। বরং তিনি এ ধরণের কর্মকান্ডকে নবী-প্রেমের নামে ভন্ডামী হিসেবে তুলে ধরেছেন। দু'টি উদাহরণ দিয়েও তিনি বিষয়টি বুঝিয়েছেন।
এতটুকু আলোচনা থেকে এটা যদিও প্রমানিত হয় যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. এর সঠিক মতামত হচ্ছে, মীলাদুন্নবী সামগ্রীকভাবে এবং সর্বাবস্থাতেই বিদআত, কিন্তু একটা প্রশ্নের সুরাহা এখনো হয় নি। সেটা হচ্ছে, ইবনে তাইমিয়ার নিকট মীলাদুন্নবী বিদআত হলে তিনি কেন এই বিদআত কর্ম পালনকারীরর সওয়াব প্রাপ্তির ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছেন? বিদআত কাজ করে কিভাবে একজন ব্যাক্তি সওয়াবের হকদার হতে পারে?
এই প্রশ্নটার সহজ সমাধান আছে।
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর উপরোক্ত ৩টি উদ্ধৃতির উপর হালকা নজর বুলালেও বুঝে আসে যে, তিনি এখানে 'মীলাদুন্নবী' পালনকারীকে অজ্ঞ হিসেবে দেখেছেন। অর্থাৎ, যে ব্যাক্তি জানেই না যে, মীলাদ পালন করা বিদআত, সে যদি রবিউল আওয়াল মাসের মীলাদকে কেন্দ্র করে দরুদ, নাত, সাদাকাহ ইত্যাদি বিশেষ কোন নেক আমল করে, তাহলে সে তার নেক নিয়্যাতের কারণে এবং রাসূলের প্রতি ভালোবাসার কারণে সওয়াব পাবে। তার বিদআত কাজটাকে এই জন্য ধরা হচ্ছে না যে, সে কাজটি অজ্ঞতাবশত করেছে। অজ্ঞতাবশত কেবল বিদআত কেন, কেউ হারাম কাজ করলেও ইসলামের বিধান হচ্ছে সেটাকে ওজর হিসেবে ধরা। এ প্রসঙ্গে ইবনে তাইমিয়া রহ. আরো স্পষ্ট করে বলেছেন:
ﺃﻥ ﻣﻦ ﻛﺎﻥ ﻟﻪ ﻧﻴﺔ ﺻﺎﻟﺤﺔ ﺃﺛﻴﺐ ﻋﻠﻰ ﻧﻴﺘﻪ، ﻭﺇﻥ ﻛﺎﻥ ﺍﻟﻔﻌﻞ ﺍﻟﺬﻱ ﻓﻌﻠﻪ ﻟﻴﺲ ﺑﻤﺸﺮﻭﻉ، ﺇﺫﺍ ﻟﻢ ﻳﺘﻌﻤﺪ ﻣﺨﺎﻟﻔﺔ ﺍﻟﺸﺮﻉ .
অর্থাৎ, "যার ভালো নিয়্যাত থাকবে সে তার নিয়্যাতের কারণে সওয়াব পাবে, যদিও তার কৃত কাজটি প্রকৃতভাবে না-জায়েয হয়, যদি সে ইচ্ছেকৃতভাবে শরীয়তের বিরোধীত না করে।" (১১) অর্থাৎ যদি সে কাজটা অজ্ঞতাবশত করে।
এর থেকে বোঝা যায় যে, যারা মীলাদ যে বিদআত সেটা কারো কাছে শুনেছে, অথবা এই বিষয়টা জানার তাদের সুযোগ ছিলো, তারপরেও তারা ইচ্ছেকৃতভাবে বা ঘাড়ত্যাড়ামি করে মীলাদুন্নবী পালন করেছে, তারা কোন অবস্থাতেই নিয়্যাতের কারণে সওয়াবের হকদার হবে না। নিয়্যাতের কারণে সওয়াব পাওয়া সংক্রান্ত ইবনে তাইমিয়্যার কথাগুলো তার উপর প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ সওয়াব পাওয়ার বিষয়টিকে ইবনে তাইমিয়্যা রহ. বিশেষ একটি অবস্থার সাথে 'খাস' করেছেন। সেটা হচ্ছে এই বিষয়ে মীলাদ পালনকারীর (ﺟﻬﺎﻟﺔ ) বা অজ্ঞতা। এটাকে ( ﺍﻟﻌﺬﺭ ﺑﺎﻟﺠﻬﺎﻟﺔ ) ওজর বিল জাহালা ধরা হবে। কিন্তু সে কারণে তার উদযাপন করা মীলাদটির হুকুমের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে না। সেটা বিদআতই থাকবে। এই কথাটা ইবনে তাইমিয়া রহ. বারবার স্পষ্ট করেছেন।
কিন্তু আমাদের উস্তাদে মুহতারাম শায়খ শরীফ হাতিম আল-আওনী হাফিজাহুল্লাহ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর খন্ডিত একটি বক্তব্যকে উল্লেখ করেছেন। যার ফলে মীলাদের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়ার অবস্থান সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। একি সাথে সেটা আমাদের দেশের কিছু তালিবে ইলমের বিভ্রান্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুন।
ওয়াল্লাহু ওয়ারা-আল কাসদ!
_______________________
টিকাঃ
(১) মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া - ২৫/২৯৮।
(২) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম, ইবনে তাইমিয়া - ২/১২৩।
(৩) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম - ২/৮২।
(৪) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম - ২/৮২।
(৫) ইসলাম অনলাইন সাইটে ২৩/১/২০১৩ তারিখে প্রকাশিত শায়খ শরীফ হাতেম আল আওনীর ফতওয়া।
(৬) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম - ২/১২৩।
(৭) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম- ২/১২৪।
(৮) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম- ২/১২৬ - ১২৮।
(৯) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম - ২/১২৩।
(১০) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম- ২/১২৪।
(১১) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম- ২/২৫১।
_________________
মীলাদুন্নবী সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর মতামত কি -- এ বিষয়ে সৌদী আরবের প্রসিদ্ধ আলেম শায়খ শরীফ হাতিম আল-আওনী (হাফি.) এর একটি লেখা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এই লেখাটির উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু ভাইকে দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় ইবনে তাইমিয়ার নামে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এর দায় অবশ্য শায়খ হাতিম আল-আওনীর ওই লেখার উপর বেশী বর্তায়। এদেশের যারা এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন তাদের সমস্যা হচ্ছে, তারা ইবনে তাইমিয়ার মূল কিতাবাদি পড়ে তাঁর মতামত না জেনে একজন শায়খের উদ্ধৃতির উপর ভরসা করেছেন।
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে ভূমিকাস্বরুপ একটি কথা বলতে চাই। আরবী পরিভাষায় 'তাজযিয়াতুন নুসুস' বলে একটি কথা আছে। এর অর্থ হচ্ছে, কারো কোন বক্তব্যকে কাটছাঁট করে নিজের পছন্দমতো স্থান উল্লেখ করা। এটা যে সবসময় ইচ্ছেকৃতভাবে এবং অসৎ উদ্দেশ্যে হয় সেটা নয়। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, উক্ত বিষয়ে ব্যাক্তিটির অপর্যাপ্ত জানাশোনা দায়ী থাকে। সব রেফারেন্স ঘেঁটে কোন বিষয়ে কারো পূর্নাঙ্গ বক্তব্য দাঁড় করাতে তিনি সক্ষম হননি। ফলে কারো নির্দিষ্ট একটি কথা কোট করে তার উপর একটি হুকুম লাগিয়ে দেন। এভাবেই বিভ্রান্তি ছড়ায়। আবার কেউ কাজটা অসৎ উদ্দেশ্যেও করে থাকে। ইচ্ছে করে কারো খন্ডিত বক্তব্য উল্লেখ করে তার সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা প্রচার করে।
এই ব্যাপারটা কেবল কোন ইমাম কিংবা আলিমের ক্ষেত্রেই নয়; বরং কোরআন এবং হাদীসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোরআন এবং হাদীসের এমন কিছু উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, যেগুলোকে খালি চোখে দেখলে পরষ্পর বিরোধী মনে হয়। এসব ক্ষেত্রে বৈপরীত্যটা কেবল বাহ্যিকভাবে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে কোন বৈপরীত্য থাকে না। কোরআন এবং হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণ দলিল প্রমানের ভিত্তিতে বিশদ আলোচনার মাধ্যমে এগুলোর মধ্যে বিভিন্নভাবে সামঞ্জস্য বিধান করে থাকেন। এ বিষয়ে 'মুখতালাফুল হাদীস' নামে আলাদা একটি শাস্ত্রেরও গোড়াপত্তন করা হয়েছে এবং এই বিষয়ে প্রচুর কিতাবাদিও লেখা হয়েছে। এখন কেউ যদি এই ধরণের কোন বিষয়ে নির্দিষ্ট একটি বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে সেটাকে ইসলামের অবস্থানরুপে দেখাতে চায় তাহলে সেটা নিশ্চিতভাবেই ভুল কাজ হবে।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। শায়খ শরীফ হাতিম আল-আওনী আমার উস্তাদ। নিয়মতি উস্তাদ না, তবে তাঁর দরসে বসার সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আমার কথাও হয়েছে। একটি সেলফীও তোলা আছে। কেউ চাইলে মেসেঞ্জারে দেবো। ইলমে হাদীস বিষয়ে তাঁর কিতাবাদিকে আমি গুরুত্বের সাথে পড়ি। তিনি আমাদের শায়খ, খাতিমাতুল মুহাদ্দিসীন, ডক্টর আহমাদ মা'বাদ আব্দুল কারীমের ছাত্র। ডক্টর আহমাদ মা'বাদ শায়খ হাতিম আল-আওনীকে পছন্দও করেন। আযহারের হাদীসী সেমিনারগুলোতে তাঁকে নিয়মিত দাওয়াত দেন।
এই কথাগুলো বলার কারণ হচ্ছে, শায়খ হাতিম আল-আওনীর ব্যাপারে আমার জানাশোনা এবং তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার ব্যাপারটা বোঝানো।
শায়খ শরীফ হাতিমের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে, তিনি ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মীলাদ সংক্রান্ত উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়ার পূর্নাঙ্গ বক্তব্য উল্লেখ করেন নি। এ বিষয়ে ইবনে তাইমিয়ার মূল ফতওয়া কি সেটাও উল্লেখ করেন নি। যে অংশটি উল্লেখ করেছেন সেটাকেও এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, এর কারণে পাঠকের মনে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। তিনি যে অর্থে ইবনে তাইমিয়ার কথাটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন সে অর্থে ইবনে তাইমিয়া রহ. কথাটি বলেছেন -- এমনটাও প্রমাণিত হয় না। বিষয়টা সামনের আলোচনায় স্পষ্ট হবে।
মীলাদুন্নবী সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মূল ফতোয়া কি?
প্রচলিত মীলাদ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ফতোয়া হচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ বিদআত। তাঁকে মাওলিদের রাত সম্পর্কে মাসআলা জিজ্ঞাসা করে হলে তিনি বলেছিলেন:
ﻭَﺃَﻣَّﺎ ﺍﺗِّﺨَﺎﺫُ ﻣَﻮْﺳِﻢٍ ﻏَﻴْﺮِ ﺍﻟْﻤَﻮَﺍﺳِﻢِ ﺍﻟﺸَّﺮْﻋِﻴَّﺔِ ﻛَﺒَﻌْﺾِ ﻟَﻴَﺎﻟِﻲ ﺷَﻬْﺮِ ﺭَﺑِﻴﻊٍ ﺍﻟْﺄَﻭَّﻝِ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﻳُﻘَﺎﻝُ : ﺇﻧَّﻬَﺎ ﻟَﻴْﻠَﺔُ ﺍﻟْﻤَﻮْﻟِﺪِ ﺃَﻭْ ﺑَﻌْﺾِ ﻟَﻴَﺎﻟِﻲِ ﺭَﺟَﺐٍ ﺃَﻭْ ﺛَﺎﻣِﻦَ ﻋَﺸَﺮَ ﺫِﻱ ﺍﻟْﺤِﺠَّﺔِ ﺃَﻭْ ﺃَﻭَّﻝِ ﺟُﻤْﻌَﺔٍ ﻣِﻦْ ﺭَﺟَﺐٍ ﺃَﻭْ ﺛَﺎﻣِﻦِ ﺷَﻮَّﺍﻝٍ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻳُﺴَﻤِّﻴﻪِ ﺍﻟْﺠُﻬَّﺎﻝُ ﻋِﻴﺪَ ﺍﻟْﺄَﺑْﺮَﺍﺭِ ﻓَﺈِﻧَّﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﺍﻟْﺒِﺪَﻉِ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﻟَﻢْ ﻳَﺴْﺘَﺤِﺒَّﻬَﺎ ﺍﻟﺴَّﻠَﻒُ ﻭَﻟَﻢْ ﻳَﻔْﻌَﻠُﻮﻫَﺎ ﻭَﺍَﻟﻠَّﻪُ ﺳُﺒْﺤَﺎﻧَﻪُ ﻭَﺗَﻌَﺎﻟَﻰ ﺃَﻋْﻠَﻢُ .
অর্থাৎ, "শরীয়তের বৈধ দিবস ছাড়া অন্যকোন দিবস যেমন, রবিউল আওয়ালের যে রাতকে 'লাইলাতুল মাওলিদ' বলা হয়, এভাবে রজব মাসের নির্দিষ্ট কোন রাত, জুলহজ্জ মাসের ১৮ তারিখের রাত, রজব মাসের প্রথম জুমার দিন এবং শাওয়াল মাসের দিন যেটাকে অজ্ঞ লোকেরা 'ঈদুল আবরার' বলে -- এগুলো সবই এমন সব বিদআত কর্মকান্ড যেগুলোকে আমাদের সালাফগণ পছন্দ করেন নি এবং পালনও করেন নি। আল্লাহ সর্বজ্ঞানী।" (১)
শায়খ শরীফ হাতিম ইবনে তাইমিয়ার কিতাব 'ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম'-এর যে জায়গাটার উদ্ধৃতি দিয়েছেন তার ৩ পৃষ্ঠা পূর্বে ইবনে তাইমিয়া রহ. লিখেছেন:
ﻓﺈﻥ ﻫﺬﺍ ﻟﻢ ﻳﻔﻌﻠﻪ ﺍﻟﺴﻠﻒ، ﻣﻊ ﻗﻴﺎﻡ ﺍﻟﻤﻘﺘﻀﻲ ﻟﻪ ﻭﻋﺪﻡ ﺍﻟﻤﺎﻧﻊ ﻣﻨﻪ ﻟﻮ ﻛﺎﻥ ﺧﻴﺮًﺍ . ﻭﻟﻮ ﻛﺎﻥ ﻫﺬﺍ ﺧﻴﺮًﺍ ﻣﺤﻀﺎ، ﺃﻭ ﺭﺍﺟﺤًﺎ ﻟﻜﺎﻥ ﺍﻟﺴﻠﻒ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻢ ﺃﺣﻖ ﺑﻪ ﻣﻨﺎ، ﻓﺈﻧﻬﻢ ﻛﺎﻧﻮﺍ ﺃﺷﺪ ﻣﺤﺒﺔ ﻟﺮﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻭﺗﻌﻈﻴﻤًﺎ ﻟﻪ ﻣﻨﺎ، ﻭﻫﻢ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺨﻴﺮ ﺃﺣﺮﺹ .
"এই কাজটা (মওলিদ উদযাপন) সালাফ আলেমদের কেউই করেন নি, এই কাজের প্রতি উৎসাহব্যাঞ্জক কারণ ( ﻣﻘﺘﻀﻲ ) থাকা সত্ত্বেও এবং এর বিরুদ্ধে কোন বাধা (ﻣﺎﻧﻊ) না থাকা সত্ত্বেও। যদি এই কাজটার কল্যানকর হতো অথবা উচিত হতো তাহলে পূর্ববর্তী আলেমগণ এর বেশী হক্বদার ছিলেন। কারণ তারা আমাদের চেয়েও বেশী নবী-প্রেমিক ছিলেন। রাসুলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও তারা এগিয়েছিলেন এবং উত্তম কাজের ব্যাপারে তারা অধিক সচেতন ছিলেন।" (২)
এর থেকে পষ্ট হয় যে, ইবনে তাইমিয়া রাহ. মীলাদ সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠানকে স্পষ্ট বিদআত মনে করতেন এবং এর থেকে মুসলমানদেরকে সতর্ক করেছেন।
এছাড়াও ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. যাবতীয় নবআবিষ্কৃত ঈদ, দিবস এবং ইসলাম সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সাধারণ ফতওয়া প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন:
ﺳﺎﺋﺮ ﺍﻷﻋﻴﺎﺩ ﻭﺍﻟﻤﻮﺍﺳﻢ ﺍﻟﻤﺒﺘﺪﻋﺔ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﻨﻜﺮﺍﺕ ﺍﻟﻤﻜﺮﻭﻫﺎﺕ ﺳﻮﺍﺀ ﺑﻠﻐﺖ ﺍﻟﻜﺮﺍﻫﺔ ﺍﻟﺘﺤﺮﻳﻢ ﺃﻭ ﻟﻢ ﺗﺒﻠﻐﻪ .
অর্থাৎ, "যাবতীয় নবআবিষ্কৃত ঈদ এবং দিবস (ইসলাম সংক্রান্ত অনুষ্ঠান) নিন্দনীয়, পরিত্যজ্য এবং মাকরুহের অন্তর্ভুক্ত। মাকরুহের স্তরটা হারামের পর্যায়ে পৌঁছুক বা না পৌঁছুক।"(৩)
তিনি অন্যত্র লিখেছেন:
ﻣﺎ ﺃﺣﺪﺙ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﻮﺍﺳﻢ ﻭﺍﻷﻋﻴﺎﺩ ﻓﻬﻮ ﻣﻨﻜﺮ ﻭﺇﻥ ﻟﻢ ﻳﻜﻦ ﻓﻴﻪ ﻣﺸﺎﺑﻬﺔ ﻷﻫﻞ ﺍﻟﻜﺘﺎﺏ .
অর্থাৎ, নবআবিষ্কৃত ঈদ এবং দিবসসমূহ মুনকার (পরিত্যজ্য), যদিও সেগুলো আহলে কিতাবের অনুষ্ঠানের সাথে সাদৃশ্য না হয়।(৪)
পূর্বে উল্লেখিত ইবনে তাইমিয়া রহ. এর মিলাদ সংক্রান্ত ফতওয়াগুলোর সাথে পরের দুটি সাধারণ ফতওয়াকে মিলিয়ে দেখলে এ বিষয়টি আরও পষ্ট হয় যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. এর সঠিক অবস্থান হচ্ছে, তিনি মীলাদুন্নবির যাবতীয় রুপকে বিদআত মনে করতেন।
শায়খ শরীফ হাতিম আল-আওনীর দাবী:
এবার শায়খ হাতিম আল-আওনী ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর যে কথাটার উদ্ধৃতি দিয়েছেন সেটা দেখা যাক। তিনি বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে মীলাদকে জায়েয প্রমান করতে গিয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. সম্পর্কে লিখেছেন:
ﺑﻞ ﻫﺬﺍ ﺷﻴﺦ ﺍﻹﺳﻼﻡ ﺍﺑﻦ ﺗﻴﻤﻴﺔ ﻓﻲ ﻛﺘﺎﺑﻪ ( ﺍﻗﺘﻀﺎﺀ ﺍﻟﺼﺮﺍﻁ ﺍﻟﻤﺴﺘﻘﻴﻢ ) ، ﻣﻊ ﺣﻜﻤﻪ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻤﻮﻟﺪ ﺑﺄﻧﻪ ﺑﺪﻋﺔ؛ ﺇﻻ ﺃﻧﻪ ﻋﺬﺭ ﻣﻘﻴﻤﻴﻪ، ﺑﻞ ﺍﻋﺘﻘﺪ ﺣﺼﻮﻝ ﺍﻷﺟﺮ ﺍﻟﻌﻈﻴﻢ ﻟﻬﻢ ﻓﻴﻪ، ﻓﻘﺎﻝ ( ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ ) : ( ﻓﺘﻌﻈﻴﻢ ﺍﻟﻤﻮﻟﺪ، ﻭﺍﺗﺨﺎﺫﻩ ﻣﻮﺳﻤﺎ، ﻗﺪ ﻳﻔﻌﻠﻪ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻨﺎﺱ، ﻭﻳﻜﻮﻥ ﻟﻪ ﻓﻴﻪ ﺃﺟﺮ ﻋﻈﻴﻢ؛ ﻟﺤﺴﻦ ﻗﺼﺪﻩ، ﻭﺗﻌﻈﻴﻤﻪ ﻟﺮﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ . ﻛﻤﺎ ﻗﺪﻣﺘﻪ ﻟﻚ : ﺃﻧﻪ ﻗﺪ ﻳﺤﺴﻦ ﻣﻦ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻨﺎﺱ، ﻣﺎ ﻳﺴﺘﻘﺒﺢ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺆﻣﻦ ﺍﻟﻤﺴﺪﺩ ).
অর্থাৎ, "... বরং শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া স্বীয় কিতাব 'ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীমে' মীলাদকে বিদআত বলা সত্ত্বেও মীলাদ পালনকারীদেরকে মা'যুর সাব্যস্ত করেছেন (অর্থাৎ, তাদেরকে মন্দ ভাবেন নি)। শুধু তাই নয়; মীলাদ পালন করার কারণে তাদের অনেক বড় সওয়াব হাসিল হবে বলেও মনে করেছেন। তিনি (ইবনে তাইমিয়া) বলেছেন: "মীলাদকে সম্মান করা এবং এটাকে নির্দিষ্ট দিবস বানানো -- এই কাজটা অনেকে করে থাকে। তার নেক নিয়্যাত এবং রাসূলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কারণে এই কাজের জন্য সে সওয়াবও পাবে। যেমনটা আমি পূর্বেও বলে এসেছি যে, সাধারণ মুসলমানের এমন কিছু কিছু কাজকে মেনে নেয়া হয়, যেগুলো পোক্ত মুমিনের ক্ষেত্রে নিন্দনীয় হিসেবে ধরা হয়।"(৫)
শায়খ হাতিম আল-আওনী এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর বলা "নেক নিয়্যাত এবং রাসূলের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কারণে সে সওয়াবও পাবে" -- এই কথাটির উপর ফোকাস করেছেন। এর ভিত্তিতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. সামগ্রীকভাবে মীলাদকে মন্দ ভাবতেন না।
এই উদ্ধৃতিটি ছাড়া ইবনে তাইমিয়ার আর কোন বক্তব্য তিনি উল্লেখ করেন নি। মূলত: ইবনে তাইমিয়ার এ ধরণের আরো ২টি বক্তব্য পাওয়া যায়, যেগুলোকে সরল চোখে দেখলে মনে হবে যে, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. মীলাদ পালনকরাকে সওয়াবের কাজ মনে করতেন।
১ম উদ্ধৃতি: ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন:
ﻭﻛﺬﻟﻚ ﻣﺎ ﻳﺤﺪﺛﻪ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻨﺎﺱ، ﺇﻣﺎ ﻣﻀﺎﻫﺎﺓ ﻟﻠﻨﺼﺎﺭﻯ ﻓﻲ ﻣﻴﻼﺩ ﻋﻴﺴﻰ ﻋﻠﻴﻪ ﺍﻟﺴﻼﻡ، ﻭﺇﻣﺎ ﻣﺤﺒﺔ ﻟﻠﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ، ﻭﺗﻌﻈﻴﻤًﺎ . ﻭﺍﻟﻠﻪ ﻗﺪ ﻳﺜﻴﺒﻬﻢ ﻋﻠﻰ ﻫﺬﻩ ﺍﻟﻤﺤﺒﺔ ﻭﺍﻻﺟﺘﻬﺎﺩ، ﻻ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺒﺪﻉ - ﻣﻦ ﺍﺗﺨﺎﺫ ﻣﻮﻟﺪ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻋﻴﺪًﺍ .
অর্থাৎ, "অনুরুপভাবে, খ্রীষ্টানরা যেমন হযরত ঈসা (আ) এর জন্মানুষ্ঠান পালন করে তেমনি তাদেরকে অনুসরণ করতে গিয়ে অথবা নবীজীর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে কেউ কেউ মীলাদ সংক্রান্ত যেসব বিষয় আবিষ্কার করে, সেগুলোর ক্ষেত্রে আল্লাহ তাদেরকে সওয়াব দান করবেন, তাদের মুহাব্বাত এবং পরিশ্রমের কারণে, বিদআতের কারণে নয়।"(৬)
২য় উদ্ধৃতি: তিনি বলেছেন:
ﻭﺃﻛﺜﺮ ﻫﺆﻻﺀ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﺗﺠﺪﻫﻢ ﺣﺮﺍﺻًﺎ ﻋﻠﻰ ﺃﻣﺜﺎﻝ ﻫﺬﻩ ﺍﻟﺒﺪﻉ، ﻣﻊ ﻣﺎ ﻟﻬﻢ ﻣﻦ ﺣﺴﻦ ﺍﻟﻘﺼﺪ، ﻭﺍﻻﺟﺘﻬﺎﺩ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﻳﺮﺟﻰ ﻟﻬﻢ ﺑﻬﻤﺎ ﺍﻟﻤﺜﻮﺑﺔ ...
অর্থাৎ, "...এদের অধিকাংশ লোক, যাদেরকে এসব বিদআতের প্রতি গুরুত্বশীল হতে দেখো, যারা তাদের নেক নিয়্যাত এবং পরিশ্রমের কারণে সওয়াব পাবে বলে আশা করা যায়..."(৭)
উপরোল্লেখিত ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর ৩টি উদ্ধৃতিতে যে বিষয়টি কমন পাওয়া যাচ্ছে সেটা হলো: তিনি মীলাদ পালনকারীদের জন্য দু'টি ওজর তালাশ করেছেন -- নবী-প্রেম ও পরিশ্রম, এবং তাদের সওয়াব প্রাপ্তির ব্যাপারে আশা ব্যাক্ত করেছেন। এর থেকে শায়খ হাতিম আল-আওনী'সহ কেউ কেউ ধরে নিয়েছেন যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. মীলাদ উদযাপন করাকে মন্দ ভাবেন নি। বরং শর্তসাপেক্ষে জায়েয মনে করতেন।
তাহলেতো এই মতটি পূর্বে উল্লেখিত তাঁর ফতোয়ার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে গেল! এর সমাধান কী হবে?
মূলত: আমরা যদি এই ৩টি উদ্ধৃতিকে সেগুলোর আগের এবং পরের ইবারতের সাথে মিলিয়ে দেখি তাহলেও এই সংশয় থাকার অবকাশ থাকে না যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. মীলাদের ব্যাপারে কোন রকম শীতিলতা প্রদর্শন করেছিলেন।
০১ নং উদ্ধৃতির উপর পর্যালোচনা:
এটা শায়খ হাতিম আল-আওনী উল্লেখ করেছেন। এই কথাটি ইবনে তাইমিয়া রহ. মুসলমানদের আমলের প্রকার উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন। তিনি আমলকে ৩ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: ১. সর্বদিক দিয়ে নেক এবং জায়েয আমল, যেটাতে কোন রকমের কারাহাত বা নিন্দনীয় কিছু নেই। ২. ভালো এবং খারাপের মিশ্রিত আমল। যেগুলোতে নিয়্যাত বা অন্যকোন জায়েয কর্মের কারণে ভালো দিকও যেমন আছে, অনুরুপ অন্য হিসেবে দিয়ে খারাপ দিকও আছে। ৩. যেগুলো সর্বদিক দিয়ে মন্দ কাজ। ইবনে তাইমিয়া রহ. ২য় প্রকারের উদাহরণ দিতে গিয়ে মীলাদের কথা উল্লেখ করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি এই প্রকারের মধ্যে ( ﺻﻮﻡ ﻭﺻﺎﻝ) বা লাগাতার নফল রোজা রাখা, বৈধ যৌনকর্ম ত্যাগ করা, কোন কোন রাতকে নির্দিষ্ট করে ইবাদত করা, যেমন রজব মাসের প্রথম রাত ইত্যাদি। এর সবগুলোর মধ্যে কিছু ভালো দিক আছে আবার কিছু মন্দ দিক আছে। মীলাদের রাতে এবং রজব মাসের প্রথম রাতে নামাজ, দোয়া দরুদ পড়া, যৌনতা এবং নফসের খাহেশাত থেকে দূরে থাকা, রোজা রাখা -- এসব হচ্ছে ভালো দিক। কিন্তু এগুলোর প্রত্যেকটিতেই মন্দ দিক আছে। মীলাদের রাত বা রজবের রাতের ইবাদতের মন্দ দিক হচ্ছে, এসব দিবসকে উদযাপন করা এবং এই উপলক্ষে বিশেষ ইবাদতের প্রচলন করা বিদআত। নবীজী, সাহাবীগণ এবং সালাফের কোন আলেমগণ এসব কষ্মিনকালেও করেন নি। এভাবে 'সওমে ওয়েসাল' বা লাগাতার নফল রোজা রাখার মধ্যে রোজা জিনিসটাতো নেক আমল, কিন্তু সেটাকে এভাবে বিরতিহীনভাবে রাখাটা মাকরুহ এবং সুন্নাত পরিপন্থি। এধরণের কাজগুলোর ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন যে, যদি দ্বীনের ব্যাপারে সাধারণত উদাসীন থাকে এমন কোন সাধারণ মুসলমান যদি এই কাজগুলো করে ফেলে তাহলে সে তার 'নেক নিয়্যাতের' কারণে সওয়াব পাবে। দেখুন তাইমিয়া বলেছেন যে, সে ব্যাক্তি তার নিয়্যাতের কারণে সওয়াব পাবে। কিন্তু তাই বলে কাজটা বৈধ হয়ে যাবে না। বরং সেটা অবৈধই থাকবে। যেমন 'বিরতিহীনভাবে নফল রোজা রাখা' তার জন্য বৈধ হয়ে যায়নি। বৈধ স্ত্রী সঙ্গম ত্যাগ করা তার জন্য জায়েজ হয়ে যায়নি। অনুরুপভাবে সে বিদআতের বিষয়টি না জেনে যদি রবিউল আওয়াল মাসে মীলাদ উপলক্ষে নামাজ, সদকাহ ইত্যাদি কোন নেক আমল করে তাহলে সে তার নেক নিয়্যাতের কারণে সওয়াব পাবে। কারণ সে বিদআতের হুকুমটি জানে না। কিন্তু তাই বলে মীলাদ পালনকরাটা বৈধ হয়ে যাবে না, সেটা বিদআতই থাকবে। এর একটি উদাহরণও তিনি দিয়েছেন। ইমাম আহমাদ ইবনে হান্বাল (রহ) এর মাযহাব হচ্ছে কোরআন শরীফকে বিভিন্ন কারুকার্যময় করে সাজানো মাকরুহ। একদিন এক লোক এসে তাঁকে বললো: অমুক আমির তার কোরআনকে সজ্জিত করার পেছনে ১ হাজার দীনার ব্যায় করেছে। এটা শুনে ইমাম আহমাদ বললেন: "তাদেরকে ছেড়ে দাও। এটা তাদের স্বর্ণমুদ্রা ব্যায় করার জন্য ভালো জায়গা।" নতুবা তারা নর্তকিদের পেছনে গোনাহের কাজে সেগুলো ব্যায় করতো। ইমাম আহমাদের এই কথার অর্থ এই নয় যে, কোরআনকে স্বর্ণ-রুপা দিয়ে সজ্জিত করা বৈধ। বরং তিনি বিশেষ ব্যাক্তির ক্ষেত্রে তার বিশেষ পরিস্থিতির কারণে বলেছেন যে, তাকে ছেড়ে দাও। তাঁর নিকট কোরআনকে সজ্জিত করা মাকরুহ হওয়া'র মাসআলাটি অপরিবর্তিতই থাকবে। শায়খ হাতিম আল-আওনী ইবনে তাইমিযার যে ইবারতটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন তার পরের ৩টি পৃষ্ঠা দেখলে এই কথাগুলো পষ্ট হয়ে যায়।(৮)
০২ নং উদ্ধৃতির পর্যালোচনা:
এই উদ্ধৃতির ক্ষেত্রেও একই কথা। এই ইবারতের উপরের ৫টি লাইনের উপর দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন:
"এই দিনটিকে (গদীরে খামের দিন) ঈদ হিসেবে পালন করা নবআবিষ্কৃত কাজ, যার কোন শরয়ী ভিত্তি নেই। সালাফের মধ্যে এবং আহলে বাইতের মধ্যে এমন কোনও ব্যাক্তি নেই যে এই দিনটিকে বিশেষ আমলের জন্য ঈদ হিসেবে উদযাপন করেছে। কারণ ঈদ হচ্ছে একটি শরীয়তের বিধান। অতএব, এ ক্ষেত্রে শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণ করতে হবে। কোনভাবেই ইচ্ছে মতো নতুন কিছু আবিষ্কার করা যাবে না। ...... এরকম কাজগুলো মূলত ইহুদী এবং খ্রীষ্টানরা করে থাকে। খ্রীষ্টানরা যেমন হযরত ঈসা (আ) এর বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান পালন করে। বস্তুত ঈদ হচ্ছে শরয়ী বিধান। আল্লাহ শরীয়ত হিসেবে যেটা বৈধ করেছেন সেটা অনুকরণীয় হবে।"
এতটুকু বলার পরে তিনি বলেছেন:
"অনুরুপভাবে যারা খ্রীষ্টানদের অনুসরণ করে অথবা নবী-প্রেমের কারণে রাসূলুল্লাহ (স) এর নামেও এরকম কিছু করে থাকে তাহলে সে নেক নিয়্যাতের কারণে তো সওয়াব পাবে, কিন্তু তা কোনভাবেই তার বিদআত কর্মের কারণে নয়। তাছাড়া, মওলিদের তারিখ নিয়েতো এমনিতেই মতভিন্নতা আছে।"
এরপর তিনি বলেছেন:
"এই কাজটি পূর্ববর্তী আলেমদের মধ্যে কেউ করেন নি। (ﻣﻘﺘﻀﻲ ) থাকা সত্ত্বেও এবং ( ﻣﺎﻧﻊ) না থাকা সত্ত্বেও। যদি এটা নেক কাজ হতো তাহলে সালফগণই এই কাজের বেশী হকদার ছিলেন। কারণ তারা আমাদের চেয়েও নবীজীকে বেশী ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন।"(৯)
ইবনেই তাইমিয়া রহ. এর এই বক্তব্যের মধ্যে ৩ টি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ:
১. তিনি মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠানকে শীয়াদের অনুষ্ঠান 'গাদীরে খাম' এবং খ্রীষ্টানদের ক্রীষ্টমাসের সাথে তুলনা করে একই ক্যাটাগরীতে উল্লেখ করেছেন। অতএব, গদীরে খাম যদি না-জায়েয অনুষ্ঠান হয় তাহলে মীলাদুন্নবীকে ইবনে তাইমিয়া কিভাবে জায়েয মনে করবেন?
২. তিনি এগুলোকে 'ঈদ' (অর্থৎ 'অনুষ্ঠানের দিন') শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করছেন। বর্তমানে যেমন 'ঈদে মীলাদুন্নবী' বলা হয়। তারপর তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, ঈদ 'তাওকীফী' বিষয়। এটা শরীয়তের একটি বিধান। শরীয়তে যে দিনগুলোকে বিশেষভাবে পালন করার বিধান রাখা হয়েছে সেগুলোকেই কেবল 'ঈদ' বা বিশেষ দিন হিসেবে পালন করা যাবে। খেয়ালখুশী মতো নতুন কিছু আবিষ্কার করা যাবে না।
৩. নবীজী, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তবেতাবেয়ীন এবং সালফে সালেহীনের মধ্যে কেউ কাজটি করে নি। মুক্তাদী (ﻣﻘﺘﻀﻲ ) থাকা সত্ত্বেও এবং মানে' (ﻣﺎﻧﻊ) না থাকা সত্ত্বেও। অর্থাৎ, রাসূলের জন্মকে কেন্দ্র করে কোন বিশেষ কিছু পালন করা যদি নেক কাজ হতো তাহলে অবশ্যই তার বিধান রাসূলের যুগেই নাযিল হতো। নবীজী এবং সাহাবীগণ সেটা পালন করতেন। যেমন আশুরার রোজার বিধান এসেছে। কারণ আল্লাহ দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। কোন হুকুম বাদ রাখেন নি। এটা যদি দ্বীন হতো তাহলে তার তাকাজা বা দাবী হচ্ছে এই ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম নাযিল হওয়া। দ্বিতীয়ত কোন (ﻣﺎﻧﻊ) বা বাধাও ছিলো না।
এই ৩ নং পয়েন্টটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. বিদআতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্তের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। বিদআত বলা হয় নবী-যুগ এবং সাহাবী-যুগের পরবর্তী সময়ে এমন নতুন কিছু আবিষ্কার করা যেটা ( ﻣﻘﺘﻀﻲ ) থাকা সত্ত্বেও এবং কোন রকম ( ﻣﺎﻧﻊ) না-থাকা সত্ত্বেও নবীজী এবং সাহাবায়ে কেরাম করেন নি এবং কোরআন-হাদীসে যার কোন (ﺃﺻﻞ ) বা ভিত্তি পাওয়া যায় না। এটা বিদআতের নিখুঁত সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞাটিকে ইবনে তাইমিয়া রহ. মীলাদুন্নবীর উপর প্রয়োগ করেছেন। তারপরেও কি বলা হবে যে, ইবনে তাইমিয়্যা মীলাদকে সামগ্রীকভাবে বিদআত মনে করতেন না?!
০৩ নং উদ্ধৃতির পর্যালোচনা:
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর এই বক্তব্যটা আরো বেশী স্পষ্ট। এই ইবারতটাকেও যদি আমরা তার পূর্বের এবং পরের কিছু ইবারতসহ পাঠ করি তাহলে দেখতে পাবো যে তিনি বলেছেন: "রাসূলের প্রকৃত ভালোবাসা হচ্ছে তার অনুসরণ-অনুকরণ করা, তার সুন্নাতকে ভেতরে বাইরে জিন্দা করা এবং এর পেছনে নিজের অন্তর, হাত এবং জবান দ্বারা সর্বাত্মক শ্রম ব্যায় করা। এটাই সকল সাহাবী এবং তাঁদের অনুসারীদের তরীকা। আর ঐ সকল লোক যাদেরকে তোমরা এ ধরণের বিদআত কর্মকান্ডের প্রতি বেশী আগ্রহী হতে দেখো -- যদিও তারা নেক নিয়্যাত এবং শ্রমের বদৌলতে সওয়াব পাবে বলে আশা করা যায় -- তাদেরকে তোমরা দেখবে যে, তারা নবীজী যেসকল কাজের নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলো থেকে পলায়ন করে। এরা ঐসকল মানুষের মতো, যারা কোরআনকে বিভিন্নভাবে সজ্জিত করে রাখে, কিন্তু কোরআন পড়ে না। অথবা পড়ে, কিন্তু আমল করে না। এবং তাদের মতো যারা মসজিদে কারুকার্য করে ঠিকই, কিন্তু সেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে না।"(১০)
এই পূর্ণাঙ্গ ইবারতটি পড়ার পর কারো এরকম সংশয় জাগার কথা নয় যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে মীলাদের কোন প্রকারকে জায়েয দেখাতে চেয়েছেন। বরং তিনি এ ধরণের কর্মকান্ডকে নবী-প্রেমের নামে ভন্ডামী হিসেবে তুলে ধরেছেন। দু'টি উদাহরণ দিয়েও তিনি বিষয়টি বুঝিয়েছেন।
এতটুকু আলোচনা থেকে এটা যদিও প্রমানিত হয় যে, ইবনে তাইমিয়া রহ. এর সঠিক মতামত হচ্ছে, মীলাদুন্নবী সামগ্রীকভাবে এবং সর্বাবস্থাতেই বিদআত, কিন্তু একটা প্রশ্নের সুরাহা এখনো হয় নি। সেটা হচ্ছে, ইবনে তাইমিয়ার নিকট মীলাদুন্নবী বিদআত হলে তিনি কেন এই বিদআত কর্ম পালনকারীরর সওয়াব প্রাপ্তির ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছেন? বিদআত কাজ করে কিভাবে একজন ব্যাক্তি সওয়াবের হকদার হতে পারে?
এই প্রশ্নটার সহজ সমাধান আছে।
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর উপরোক্ত ৩টি উদ্ধৃতির উপর হালকা নজর বুলালেও বুঝে আসে যে, তিনি এখানে 'মীলাদুন্নবী' পালনকারীকে অজ্ঞ হিসেবে দেখেছেন। অর্থাৎ, যে ব্যাক্তি জানেই না যে, মীলাদ পালন করা বিদআত, সে যদি রবিউল আওয়াল মাসের মীলাদকে কেন্দ্র করে দরুদ, নাত, সাদাকাহ ইত্যাদি বিশেষ কোন নেক আমল করে, তাহলে সে তার নেক নিয়্যাতের কারণে এবং রাসূলের প্রতি ভালোবাসার কারণে সওয়াব পাবে। তার বিদআত কাজটাকে এই জন্য ধরা হচ্ছে না যে, সে কাজটি অজ্ঞতাবশত করেছে। অজ্ঞতাবশত কেবল বিদআত কেন, কেউ হারাম কাজ করলেও ইসলামের বিধান হচ্ছে সেটাকে ওজর হিসেবে ধরা। এ প্রসঙ্গে ইবনে তাইমিয়া রহ. আরো স্পষ্ট করে বলেছেন:
ﺃﻥ ﻣﻦ ﻛﺎﻥ ﻟﻪ ﻧﻴﺔ ﺻﺎﻟﺤﺔ ﺃﺛﻴﺐ ﻋﻠﻰ ﻧﻴﺘﻪ، ﻭﺇﻥ ﻛﺎﻥ ﺍﻟﻔﻌﻞ ﺍﻟﺬﻱ ﻓﻌﻠﻪ ﻟﻴﺲ ﺑﻤﺸﺮﻭﻉ، ﺇﺫﺍ ﻟﻢ ﻳﺘﻌﻤﺪ ﻣﺨﺎﻟﻔﺔ ﺍﻟﺸﺮﻉ .
অর্থাৎ, "যার ভালো নিয়্যাত থাকবে সে তার নিয়্যাতের কারণে সওয়াব পাবে, যদিও তার কৃত কাজটি প্রকৃতভাবে না-জায়েয হয়, যদি সে ইচ্ছেকৃতভাবে শরীয়তের বিরোধীত না করে।" (১১) অর্থাৎ যদি সে কাজটা অজ্ঞতাবশত করে।
এর থেকে বোঝা যায় যে, যারা মীলাদ যে বিদআত সেটা কারো কাছে শুনেছে, অথবা এই বিষয়টা জানার তাদের সুযোগ ছিলো, তারপরেও তারা ইচ্ছেকৃতভাবে বা ঘাড়ত্যাড়ামি করে মীলাদুন্নবী পালন করেছে, তারা কোন অবস্থাতেই নিয়্যাতের কারণে সওয়াবের হকদার হবে না। নিয়্যাতের কারণে সওয়াব পাওয়া সংক্রান্ত ইবনে তাইমিয়্যার কথাগুলো তার উপর প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ সওয়াব পাওয়ার বিষয়টিকে ইবনে তাইমিয়্যা রহ. বিশেষ একটি অবস্থার সাথে 'খাস' করেছেন। সেটা হচ্ছে এই বিষয়ে মীলাদ পালনকারীর (ﺟﻬﺎﻟﺔ ) বা অজ্ঞতা। এটাকে ( ﺍﻟﻌﺬﺭ ﺑﺎﻟﺠﻬﺎﻟﺔ ) ওজর বিল জাহালা ধরা হবে। কিন্তু সে কারণে তার উদযাপন করা মীলাদটির হুকুমের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে না। সেটা বিদআতই থাকবে। এই কথাটা ইবনে তাইমিয়া রহ. বারবার স্পষ্ট করেছেন।
কিন্তু আমাদের উস্তাদে মুহতারাম শায়খ শরীফ হাতিম আল-আওনী হাফিজাহুল্লাহ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর খন্ডিত একটি বক্তব্যকে উল্লেখ করেছেন। যার ফলে মীলাদের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়ার অবস্থান সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। একি সাথে সেটা আমাদের দেশের কিছু তালিবে ইলমের বিভ্রান্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনের সহীহ বুঝ দান করুন।
ওয়াল্লাহু ওয়ারা-আল কাসদ!
_______________________
টিকাঃ
(১) মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া - ২৫/২৯৮।
(২) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম, ইবনে তাইমিয়া - ২/১২৩।
(৩) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম - ২/৮২।
(৪) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম - ২/৮২।
(৫) ইসলাম অনলাইন সাইটে ২৩/১/২০১৩ তারিখে প্রকাশিত শায়খ শরীফ হাতেম আল আওনীর ফতওয়া।
(৬) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম - ২/১২৩।
(৭) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম- ২/১২৪।
(৮) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম- ২/১২৬ - ১২৮।
(৯) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম - ২/১২৩।
(১০) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম- ২/১২৪।
(১১) ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম- ২/২৫১।
No comments:
Post a Comment