মেয়েদের বোরখার মুখ খুলে রাখা যাবে কি?
এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে দ্বিমত আছে। একদল ওলামায়ে কেরাম বলেছেন যে যদি মেয়েরা মুখ খোলা রাখে, তাহলে সেটি নাজায়েজ নয়। বাধ্যতামূলক নয় যে মুখ ঢেকে রাখতে হবে, অর্থাৎ খোলা রাখা জায়েজ।
আবার আরেক দল ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, না,
মুখ ঢেকে রাখাটা ওয়াজিব, খোলা রাখাটা জায়েজ নয়। এর পক্ষে-বিপক্ষে দুই পক্ষেই বক্তব্য আছে এবং দুই পক্ষে দলিলও আছে। বিভিন্ন ধরনের দলিল দেওয়া রয়েছে।
কিন্তু একটি বিষয়ে দুই পক্ষের ওলামায়ে কেরাম ঐকমত্যে পৌঁছেছেন, সেটা হচ্ছে এই, যদি এমন হয় যে মুখ খোলা রাখার কারণে কোনো ধরনের ফিতনার আশঙ্কা থাকতে পারে, কোনো ধরনের ফিতনা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সে ক্ষেত্রে মুখ ঢেকে রাখাটা ওয়াজিব। কারণ, মুখ খোলা রাখার জন্য ফিতনা যদি হয়, তাহলে এই ফিতনার দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে তাঁকেই, যিনি মুখ খোলা রেখেছেন।
মুখ ঢেকে রাখতে হবে এ ব্যপারে আলেমদের অভিমতঃ
____________________________
শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন (রহঃ) বলেনঃ
শরীয়ত সম্মত হিজাবের অর্থ হচ্ছেঃ একজন নারী তার সম্পূর্ণ আওরাহ (দেহের এমন অংশ যা প্রদর্শন করা তার জন্য হারাম) ঢেকে রাখবেন। একজন নারীর উচিত হচ্ছে তার জন্য যা ঢেকে রাখা ফরয তা ঢেকে রাখে, এর মধ্যে প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার চেহারা। কারণ একজন নারীর চেহারাই হচ্ছে তার প্রতি কামনা বাসনার মূলবিন্দু।
একজন নারীর জন্য ওয়াজিব হচ্ছে সে তার চেহারা এমন কোনো পুরুষের সামনে প্রকাশ করবেনা, যে তার গায়ের মাহরাম। এথেকে আমরা জানতে পারি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চেহারা ঢেকে রাখা। এর অনেক দলীল রয়েছে কুরানুল কারীমে, রাসুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাতে ও সাহাবা, পূর্ববর্তী ইমাম ও আলেমদের ফতওয়াতে। এইগুলোর উপর ভিত্তি করে বুঝা যায়, একজন নারীর জন্য ওয়াজিব হচ্ছে তার সমস্ত শরীর একজন গায়ের মাহরামের সামনে ঢেকে রাখা।
ফাতাওয়া আল-মার’আহ আল-মুসলিমাহ, ১/৩৯১, ৩৯২।
_______________________________
শায়খ সালিহ আল-ফওজান (হাফিঃ) বলেনঃ
দলীলের উপর ভিত্তি করে সঠিক ফতওয়া হচ্ছে, একজন নারীর চেহারা তার আওরাহ যা কিনা অবশ্যই ঢেকে রাখতে হবে। এটা তার শরীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংগ। কারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি একজন নারীর চেহারাকেই দেখে, তাই একজন নারীর চেহার হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আওরাহ। এই যুক্তি হলো শরীয়াতের দলীলগুলো ছাড়াই অন্য আরেকটা যুক্তি – একজন নারীর চেহারা ঢেকে রাখা তার জন্য ওয়াজিব এই কথা প্রমানের জন্য।
উদাহরণ স্বরূপ আল্লাহ বলেন,
“(হে নবী আপনি) ঈমানদার নারীদেরকে বলুনঃ তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না ‘জুয়ুবিহিন্নাহ’ (শরীর, চেহারা, ঘাড় ও বুকের) উপর ফেলে রাখে...”
সুরা আন-নূর, আয়াত ৩১।
ওড়না জুয়ুবের উপর ফেলে রাখার মাঝে মুখ ঢেকে রাখাও অন্তর্ভুক্ত।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে নিচের এই আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলোঃ
“হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিন নারীদেরকে বলুনঃ তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়।” সুরা আল-আহজাব, আয়াত ৫৯।
তখন ইবনে আব্বাস (রাঃ) তিনি তার চেহারা ঢাকলেন, শুধুমাত্র এক চোখ ছাড়া। তার মানে এই আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে এই আয়াত দ্বারা ঢেকে রাখা দ্বারা চেহারাও ঢেকে রাখতে আদেশ করা হয়েছে। এই তাফসীর বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে।
এই ব্যপারে সুন্নাতে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ইহরামে থাকা অবস্থায় নারীদের জন্য চেহারা ঢেকে রাখা (নেকাব পড়া) অথবা বোরখা পড়া নিষিদ্ধ।
তার মানে এইনা যে একজন নারী ইহরাম অবস্থায় তার নেকাব বা বোরখা খুলে একজন গায়ের মাহরাম পুরুষের সামনে তার চেহারা উন্মুক্ত রাখবেন। বরং তিনি নেকাব বা বোরখা ছাড়া অন্য কোনো কিছু দিয়ে পর্দা করবেন, যেমনটা আয়িশাহ (রাঃ) এর হাদীস থেকে বর্ণিত হয়েছে।
মা আয়িশাহ (রাঃ) বলেনঃ আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে ইহরামে থাকা অবস্থায় ছিলাম। পথচারীগণ আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করত। তারা আমাদের নিকট আসলে আমরা মাথার উপর থেকে খিমার চেহারার উপর ফেলে দিতাম। তারা চলে গেলে সেটা উঠিয়ে নিতাম। সুনানে আবু দাউদঃ ১৮৩৩, ফাতহুল বারী ৩/৪৭৪।
নারীদের জন্য ইহরামে থাকা অবস্থাতে বা অন্য সময়েও ওয়াজিব হচ্ছে গায়ের মাহরাম পুরুষের সামনে তাদের চেহারা ঢেকে রাখা, কারণ তাদের চেহারাই হচ্ছে পুরষদের জন্য আকর্ষণীয় এমন সৌন্দর্যের কেন্দ্র...
ফাতাওয়া আল-মার’আহ আল-মুসলিমাহ, ১/৩৯৯।
শায়খ ফওজান আরো বলেনঃ শুধুমাত্র দুই চোখ খোলা থাকে এমন বোরখা ও নেকাব দিয়ে নারীদের জন্য চেহারা ঢেকে রাখা জায়েজ, কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগে এর প্রচলন ছিলো বলে জানা যায়। এছাড়া এটা (নেকাব+বোরখা) জরুরত (প্রয়োজনীয়তার) অন্তর্ভুক্ত। যদি এটা সমাজে বহুল প্রচলিত থাকে এবং শুধুমাত্র দুই চোখ ছাড়া অন্য কোনো কিছু প্রদর্শিত না হয়, তাহলে এমন কোনো কিছু দিয়ে হিজাব পর্দা করতে কোনো বাঁধা নেই।
এ ব্যপারেই আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।।।
ফাতাওয়া আল-মার’আহ আল-মুসলিমাহ, ১/৩৯৯।
__________________________
তাই এ ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ বক্তব্য যেটি, আহলুত তাহকিক, মাহকি,
ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, সেটি হলো এই, মুখ ঢেকে রাখাটাই হচ্ছে বিধান এবং এটাই হচ্ছে শক্তিশালী বক্তব্য। কিন্তু যেহেতু এখানে দুটি অভিমত রয়েছে, কেউ যদি মনে করেন আমি দ্বিতীয় মতটি গ্রহণ করব, তিনি গ্রহণ করতে পারেন। তবে গ্রহণ করতে হলে তাঁকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, কোনোভাবেই যাতে তাঁর মাধ্যমে ফিতনা না হয়। কারণ, যদি কোনো কারণে ফিতনা হয়, তাহলে কিন্তু তিনি গুনাহর মধ্যে লিপ্ত হবেন, এতেও কোনো সন্দেহ নেই।
No comments:
Post a Comment