Thursday, April 22, 2021

সৌদির সাথে মিল রেখে ছিয়াম ঈদ পালন করলে, একই সময় ইফতার ও নামাজ করেন না কেন?

প্রশ্ন: আপনারা সৌদির সাথে মিল রেখে রোজা রাখেন, সৌদির সাথে মিল রেখে ঈদ করেন, তাহলে সৌদির সাথে মিল রেখে একই সময় ইফতার করেন না কেন? সৌদির সাথে মিল রেখে একই সময় নামাজ পড়েন না কেন?

.

জবাব:

প্রথম কথা হচ্ছে আমরা শুধু সৌদির সাথে  মিল রেখে সিয়াম ঈদ করি না, কিংবা শুধু সৌদির চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করি না। বরং পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে নতুন চাঁদ দেখা যাওয়ার বিজ্ঞানসম্মত,  নির্ভরযোগ্য ও শরীয়াতসম্মত সংবাদ পেলে আমরা সিয়াম ও ঈদ পালন করি। অর্থাৎ আমরা রাসুল সঃ এর হাদিস অনুযায়ী নতুন চাঁদের সংবাদের ভিত্তিতে সিয়াম ঈদ করি, কোনো হারাম জাতীয়তাবাদী সীমান্ত কিংবা কোনো দেশের বর্ডার কিংবা কাঁটাতারের বেড়ার ভিত্তিতে নয়।

.

পরবর্তী কথা হচ্ছে নিচের চারটি পয়েন্ট বুঝার চেষ্টা করুন।

.

♦(১)♦  একই সময়ে আর একই দিনে কথাটির পার্থক্য:

এখানে “একই সময়” আর “একই দিনে” কথাটির পার্থক্য বুঝতে হবে। “একই সময়” অর্থ একই সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা । আর “একই দিনে” অর্থ “একই বারে” যেমন শনিবার, রবিবার, সোমবার। আমরা কখনোই বলিনি সারা পৃথিবীতে ঈদ “একই সময়ে” করতে হবে। “একই সময়”  আর “একই দিন” কথাটি এক নয়। 

সারা পৃথিবীতে নামাজ যেমন “একই সময়ে” (সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা) পড়া যায়না, রোজাও তেমনি একই সময়ে রাখা যাবেনা, অ্থাৎ সারা পৃথিবীতে একই সময়ে সাহরী করা যায়না, সারা পৃথিবীতে একই সময়ে ইফতার করা যায়না,  সারা পৃথিবীতে ঈদও তেমনি “একই সময়ে” করা যাবে না।

কিন্তু সময়ের পার্থক্য বজায় রেখেই সারা পৃথিবীতে নামাজ “একই দিনে” পড়তে হয়। যেমন জুম্মার নামাজ সারা পৃথিবীতে একই দিনে বা একই বার এ (শুক্রবারে) পড়তে হয়। বাংলাদেশে যখন রাত আমেরিকায় তখন দিন। বাংলাদেশ ও আমেরিকার সময়ের পার্থক্য প্রায় ১২ ঘন্টা। কিন্তু জুম্মার নামাজ বাংলাদেশেও শুক্রবার দুপুরে হয়, আমেরিকাতেও  শুক্রবার দুপুরে হয়। সময়ের পার্থক্য যত বেশিই হোক সারা পৃথিবীতে শুক্রবার দিনটি একই দিন। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সময়ের পার্থক্য রয়েছে বলেই সব জেলায় ইফতার একই সময় হয়না। যেমন বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে সাতক্ষীরা ও সিলেটের সময়ের পার্থক্য প্রায় ১৯ মিনিট। কক্সবাজার থেকে পঞ্চগড়ের সময়ের পার্থক্য প্রায় ২৩ মিনিট।  তবুও এক জেলা থেকে অন্য জেলার সময়ের পার্থক্য মেনে নিয়েই সারা বাংলাদেশে “একই দিনে” ঈদ পালিত হচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশের ভিতরেও সকল জেলায় একই সময় নামাজর ওয়াক্ত হয়না, “একই সময়” রোজা শুরু হয়না কিন্তু “একই দিনে” রোজা শুরু হয়। সময়ের পার্থক্য মেনে নিয়েই বাংলাদেশের যেকোনো জেলা থেকে চাঁদ দেখার সংবাদ অন্য সকল জেলায় গৃহীত হচ্ছে।  

সুতরাং সময়ের পার্থক্য মেনে নিয়েই রাসূল ﷺ এর কথা ও আমল অনুযায়ী দুইজন মুসলিমের চাঁদ দেখার নির্ভরযোগ্য সংবাদ পেলে সিয়াম ও ঈদ পালন করা জরুরী। সংবাদ গ্রহণের ক্ষেত্রে রাসূল সঃ দেশের সীমারেখা বা বর্ডার এর কোনো শর্ত দেন নি। আমরাও দেশের সীমারেখা বা বর্ডার এর কোনো শর্ত দেই না। 

.

♦(২)♦  নামাজের ওয়াক্তের সাথে রমজান মাস শুরুর তুলনা সঠিক নয়:

নামাজের ওয়াক্ত, সাহরী এবং ইফতার সূর্যের সাথে সম্পর্কিত। অপরদিকে রমজান মাস শুরু হওয়া এবং শাওয়াল মাস শুরু হওয়া বা ঈদের দিন হওয়া চাঁদের সাথে সম্পর্কিত।

নামাজের ওয়াক্ত, সাহরী এবং ইফতার সূর্যের সাথে সম্পর্কিত, চাঁদের সাথে নয়। যেমন ইফতার করতে হয় সূর্য ডোবার পর, চাঁদ ডোবার পর নয়। একইভাবে মাগরিব পড়তে হয় সূর্য ডোবার পর, চাঁদ ডোবার পর নয়। জুম্মার ওয়াক্ত যেমন সূর্য অনুযায়ী হয় ঈদের নামাজের ওয়াক্তও তেমনি সূর্য অনুযায়ী হয়। সাহরী, ইফতার ও নামাজের ওয়াক্ত চাঁদ অনুযায়ী হয়না, চাঁদের সাথে এগুলির আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং সাহরী, ইফতার ও নামাজের ওয়াক্ত হয় সূর্য অনুযায়ী।

কিন্তু প্রতি আরবী মাসের প্রথম তারিখ নির্ধারিত হয় চাঁদ অনুযায়ী। রমজান মাসের প্রথম তারিখ নির্ধারণ সূর্য উঠার দ্বারা হয় না বরং রমজানের চাঁদ দেখার দ্বারা হয়। তেমনি শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখ বা ঈদুল ফিতরের তারিখ নির্ধারণ ও সূর্য উঠার দ্বারা হয়না বরং ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার দ্বারা হয়। ঈদুল আযহার তারিখ নির্ধারণ ও সূর্য উঠার দ্বারা হয়না বরং ঈদুল আযহার চাঁদ দেখার দ্বারা হয়। রমজান মাস কবে থেকে শুরু হবে তার সাথে সূর্যের কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং রমজান মাস শুরু হওয়া চাঁদের সাথে সম্পর্কিত, ঈদ হওয়াটাও চাঁদের সাথে সম্পর্কিত ।

কাজেই "সূর্যের সাথে সম্পর্কিত নামাজের ওয়াক্ত" আর "চাঁদের সাথে সম্পর্কিত ঈদ হওয়া" এই দুইটির তুলনা যুক্তিযুক্ত নয়। সূর্য ও চাঁদের হিসাব আলাদা।

.

♦(৩)♦  দুইজন মুসলিমের সাক্ষ্য সম্পর্কে রাসূল সঃ এর আমল ও নির্দেশ নতুন চাঁদ দেখার ব্যাপারে, কিন্তু সূর্য দেখার ব্যাপারে নয়:

রাসূল সঃ মুসলিমদের মধ্যে দুইজন নতুন চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিলে রোযার মাস শুরু, ও দুইজন মুসলিম চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিলে ঈদ করতে বলেছেন। কিন্তু দুইজনের সূর্য দেখার সাক্ষ্যে সাহরী ইফতার ও সলাত (নামাজ) আদায় করতে বলেননি।

আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ রদিআল্লহু আনহু থেকে বর্ণিত, নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেন,

“...যদি (মুসলিমদের) দু’জন স্বাক্ষ্য দেয় যে, তারা (নতুন চাঁদ উদয়ের ব্যাপারে) দেখেছে, তাহলে তোমরা সাওম (রোজা) ও ঈদ পালন কর”। [নাসাঈ, সহীহ্, অধ্যায়ঃ ৮, হাদিস # ২১১৬।]

.

♦(৪)♦  নিজ এলাকায় চাঁদ না দেখা গেলেও দূরের চাঁদ দেখার সংবাদে রাসূল ﷺ ঈদ করেছেন কিন্তু দূরের সূর্য দেখার সংবাদ অনুযায়ী সলাত (নামাজ) পড়েননি:

মদীনায় চাঁদ না উঠলেও দূর দেশের চাঁদের সংবাদ শুনে রাসূল ﷺ ঈদ করেছেন, কিন্তু দূর দেশের সূর্য অনুযায়ী সলাত (নামাজ) পড়েননি এবং দূর দেশের সূর্য অনুযায়ী সাহরী ইফতারও করেননি।

দলীল: 

হযরত আবু উমাইর ইবনু আনাস রদিআল্লহু আনহু হতে বর্ণিত

“রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম-এর নিকট একদল আরোহী আসল এবং তারা সাক্ষ্য দিল যে তারা গতকাল (শাওয়ালের) নতুন চাঁদ দেখেছে। ফলে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম মানুষকে রোযা ছাড়ার আদেশ দিলেন। পরের দিন প্রাতঃকালে সকলেই ঈদগাহে সমবেত হলেন”। 

[(আবু দাউদ, সহীহ, হাদীস নং ১১৫৭, ইংরেজি অনুবাদ হাদীস নং ১১৫৩, নাসায়ী, মিশকাত-১২৭)]

অত্র হাদিসের ব্যাখ্যায় মিশকাত গ্রন্থের উক্ত পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে-

“তারা ঈদের নামাজের জন্য ঈদগাহে সমাবেত হল। আল্লামা মাজহার বলেন যে ঐ বছর মদীনা শরীফে ২৯শে রমযান দিবাগত রাতে শাওয়ালের চাঁদ দেখা যায়নি। ফলে মদীনা বাসী ৩০ রমযানের রোযা রেখে ছিলেন। এমতাবস্থায় ঐ দিন দ্বিপ্রহরে একদল ছাওয়ারী দূর থেকে আসল এবং তারা সাক্ষ্য দিল যে, নিশ্চয়ই তারা ২৯ তারিখ দিবাগত রাতে নুতন চাঁদ দেখেছে। অতপর, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদের এ সংবাদ গ্রহণ করে সকলকে সিয়াম (রোযা) ভঙ্গের নির্দেশ দিলেন এবং পরের দিন (২রা শাওয়াল) ঈদের সলাত (নামায) পড়ার নির্দেশ দিলেন”। (মিশকাত গ্রন্থের ব্যাখ্যা এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল)

[(মিরকাতুল মাফাতিহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ ৫/১৫৩)] 

সুতরাং সলাত (নামাজ), সাহরী ও ইফতার যার যার স্থানীয় সূর্য অনুযায়ী আদায় করতে হবে পক্ষান্তরে রোজা ঈদ করতে হবে পৃথিবীর যেখান থেকেই প্রথম চাঁদ দেখার নির্ভরযোগ্য সংবাদ পাওয়া যাবে সেই সংবাদ অনুযায়ী।

‘মাআরিফুস সুনান’ কিতাবে লিখিত হয়েছে

“আমাদের ফিকহের কিতাব সমূহের উপর ভিত্তি করে আমরা লিখেছি যে, এক দেশের চাঁদ দেখা অন্য দেশে গ্রহণীয় হবে। যদিও দেশ দুটির মধ্যে পশ্চিম ও পূর্বের দূরত্ব হয়। আর এ মাসয়ালা ফকীহ্‌গণের এ নীতিমালার উপর ভিত্তি করে যে চাঁদ উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় হবে না। তবে ফকিহগণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, সলাত (নামায) ও ইফতারের ওয়াক্ত সমূহের ভিন্নতা গ্রহণীয় হবে এবং যার যার স্থানীয় সময় অনুযায়ী সলাত (নামায) পড়বে ও ইফতার করবে”।

(মায়ারিফুস্‌ সুনানের উদ্ধৃতি এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) 

[(মায়ারিফুস্‌ সুনান, খন্ড-৫, পৃঃ-৩৩৭)]

No comments:

Post a Comment

বাচ্চাদের প্রাথমিক রুকইয়াহ ও বিধিনিষেধ

প্রাথমিক রুকইয়াহ পদ্ধতিঃ  ১।   মানুষ ও জ্বীনের বদনজর ও জ্বীনের আছর থেকে হিফাযত ও শিফার নিয়তে - দুরুদে ইব্রাহিম, সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি,...