যাবতীয় প্রশংসা আল্লহর। দুরুদ ও সালাম আল্লহর রসূল (স) এর উপর। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লহর নামে শুরু করছি।
ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা একটি জঘন্য পাপ এবং কবীরা গুনাহ।এ কারণে,তার শাস্তিও অতি ভয়ানক।
যেভাবেই সে আত্মহত্যা করুক না কেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَلَا تَقْتُلُوْا أَنْفُسَكُمْ، إِنَّ اللهَ كَانَ بِكُمْ
رَحِيْمًا»
‘‘এবং তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু’’। (নিসা’ : ২৯)
জুন্দাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
كَانَ
بِرَجُلٍ جِرَاحٌ فَقَتَلَ نَفْسَهُ، فَقَالَ اللهُ: بَدَرَنِيْ عَبْدِيْ
بِنَفْسِهِ، حَرَّمْتُ عَلَيْهِ الْـجَنَّةَ.
‘‘জনৈক ব্যক্তি গুরুতর আহত হলে সে তার ক্ষতগুলোর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বললেন: আমার বান্দাহ্ স্বীয় জান কবযের ব্যাপারে তড়িঘড়ি করেছে অতএব আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিলাম’’। (বুখারী ১৩৬৪)
সাবিত্ বিন্ যাহ্হাক (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ
قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَيْءٍ فِيْ الدُّنْيَا عَذَّبَهُ اللهُ بِهِ فِيْ نَارِ
جَهَنَّمَ.
‘‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন বস্ত্ত দিয়ে আত্মহত্যা করলো আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে সে বস্ত্ত দিয়েই শাস্তি দিবেন’’।
(বুখারী ১৩৬৩, ৬০৪৭, ৬১০৫, ৬৬৫২; মুসলিম ১১০)
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ
قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيْدَةٍ فَحَدِيْدَتُهُ فِيْ يَدِهِ يَتَوَجَّأُ بِهَا فِيْ
بَطْنِهِ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا، وَمَنْ شَرِبَ
سُمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ يَتَحَسَّاهُ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا
مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا، وَمَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ
فَهُوَ يَتَرَدَّى فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا.
‘‘যে ব্যক্তি কোন লোহা বা লোহা জাতীয় বস্ত্ত দিয়ে আত্মহত্যা করলো সে লোহা বা লোহা জাতীয় বস্ত্তটি তার হাতেই থাকবে। তা দিয়ে সে জাহান্নামের আগুনে নিজ পেটে আঘাত করবে এবং তাতে সে চিরকাল থাকবে। তেমনিভাবে যে ব্যক্তি বিষ পান করে আত্মহত্যা করলো সে জাহান্নামের আগুনে বিষ পান করতেই থাকবে এবং তাতে সে চিরকাল থাকবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করলো সে জাহান্নামের আগুনে লাফাতেই থাকবে এবং তাতে সে চিরকাল থাকবে’’। (বুখারী ৫৭৭৮; মুসলিম ১০৯)
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
الَّذِيْ
يَخْنُقُ نَفْسَهُ يَخْنُقُهَا فِيْ النَّارِ، وَالَّذِيْ يَطْعَنُهَا يَطْعَنُهَا
فِيْ النَّارِ.
‘‘যে ব্যক্তি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করলো সে জাহান্নামে গিয়ে এভাবেই করতে থাকবে এবং যে ব্যক্তি নিজকে বর্শা অথবা অন্য কোন কিছু দিয়ে আঘাত করে আত্মহত্যা করলো সেও জাহান্নামে গিয়ে এভাবেই করতে থাকবে’’। (বুখারী ১৩৬৫)
আত্মহত্যা জাহান্নামে যাওয়ার একটি বিশেষ কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে আগাম সংবাদ দিয়েছেন।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ’হুনাইন্ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। পথিমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক মুসলিম সম্পর্কে বললেন: এ ব্যক্তি জাহান্নামী। যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো তখন লোকটি এক ভয়ানক যুদ্ধে লিপ্ত হলো এবং সে তাতে প্রচুর ক্ষত-বিক্ষত হলো। জনৈক ব্যক্তি বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! যার সম্পর্কে আপনি ইতিপূর্বে বললেন: সে জাহান্নামী সে তো আজ এক ভয়ানক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে মৃত্যু বরণ করলো। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবারো বললেন: সে জাহান্নামী। তখন মুসলিমদের কেউ কেউ এ ব্যাপারে সন্দিহান হলো। এমতাবস্থায় সংবাদ এলো: সে মরেনি; সে এখনো জীবিত। তবে তার দেহে অনেকগুলো মারাত্মক ক্ষত রয়েছে। যখন রাত হলো তখন লোকটি আর ধৈর্য ধরতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সংবাদ দেয়া হলে তিনি বলেন: আল্লাহ্ সুমহান। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ্ তা‘আলার বান্দাহ্ ও তাঁর প্রেরিত রাসূল। অতঃপর তিনি বিলাল (রাঃ) কে এ মর্মে ঘোষণা দিতে বললেন যে,
إِنَّهُ
لَا يَدْخُلُ الْـجَنَّةَ إِلاَّ نَفْسٌ مُسْلِمَةٌ، وَإِنَّ اللهَ يُؤَيِّدُ
هَذَا الدِّيْنَ بِالرَّجُلِ الْفَاجِرِ.
‘‘একমাত্র মু’মিন ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তবে আল্লাহ্ তা‘আলা কখনো কখনো কোন কোন গুনাহ্গার ব্যক্তির মাধ্যমেও ইসলামকে শক্তিশালী করে থাকেন’’। (মুসলিম ১১১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عن أنس عن النبي صلى الله عليه و سلم
قال يخرج من النار من قال لا إله إلا الله وفي قلبه وزن شعيرة من خير ويخرج من
النار من قال لا إله إلا الله وفي قلبه وزن برة من خير ويخرج من النار من قال لا
إله إلا الله وفي قلبه وزن ذرة من خير
যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি যব পরিমাণও নেকী থাকবে,
তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে এবং যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি অণু পরিমাণও নেকী থাকবে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। (সহীহ বুখারী,
হাদীস নং ৪৪,
সহীহ মুসলিম,
হাদীস নং ১২৫)
সুতরাং আত্মহত্যাকারীও চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না। অতএব,
হাদিসে যে আত্মহত্যাকে চিরকাল জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে,
তা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। যেমন হাদিসে এসেছে,
ﻣَﻦْ ﺗَﺮَﺩَّﻯ ﻣِﻦْ ﺟَﺒَﻞٍ
ﻓَﻘَﺘَﻞَﻧَﻔْﺴَﻪُ ﻓَﻬْﻮَ ﻓِﻰ ﻧَﺎﺭِ ﺟَﻬَﻨَّﻢَ ﻳَﺘَﺮَﺩَّﻯ ﻓِﻴﻪِ ﺧَﺎﻟِﺪًﺍ
ﻣُﺨَﻠَّﺪًﺍﻓِﻴﻬَﺎ ﺃَﺑَﺪًﺍ، ﻭَﻣَﻦْ ﺗَﺤَﺴَّﻰ ﺳَﻤًّﺎ ﻓَﻘَﺘَﻞَ ﻧَﻔْﺴَﻪُ ﻓَﺴَﻤُّﻪُ
ﻓِﻰﻳَﺪِﻩِ ﻳَﺘَﺤَﺴَّﺎﻩُ ﻓِﻰ ﻧَﺎﺭِ ﺟَﻬَﻨَّﻢَ ﺧَﺎﻟِﺪًﺍ ﻣُﺨَﻠَّﺪًﺍ ﻓِﻴﻬَﺎ
ﺃَﺑَﺪًﺍ،ﻭَﻣَﻦْ ﻗَﺘَﻞَ ﻧَﻔْﺴَﻪُ ﺑِﺤَﺪِﻳﺪَﺓٍ ﻓَﺤَﺪِﻳﺪَﺗُﻪُ ﻓِﻰ ﻳَﺪِﻩِ ﻳَﺠَﺄُ
ﺑِﻬَﺎﻓِﻰ ﺑَﻄْﻨِﻪِ ﻓِﻰ ﻧَﺎﺭِ ﺟَﻬَﻨَّﻢَ ﺧَﺎﻟِﺪًﺍ ﻣُﺨَﻠَّﺪًﺍ ﻓِﻴﻬَﺎ ﺃَﺑَﺪًﺍ
আবূ হুরাইরাহ রাযি. হতে বর্ণিত,
তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর
আত্মহত্যা করবে,
সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে,
সে তার বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।(সহীহ বুখারী,
হাদীস নং-৫৪৪২)
উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় আহলুসসুন্নাহ ওয়ালজামাতের আলেমগণ বলেন,
১.ইবনে খুজাইমা রহ. বলেন,
কোরআন-হাদিসে মুমিনদের ব্যাপারে যত প্রকার শাস্তির বিবরণ এসেছে সবগুলো শর্তসাপেক্ষে। আর তা এই যে,
বর্ণিত শাস্তি আল্লাহ চাইলে মাফ হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,إِنَّ اللّهَ لاَ يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ
بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَن يَشَاءনিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না,
যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা,
ক্ষমা করেন। (সূরা নিসা-১১৬) সুতরাং আলোচ্য হাদিসে বর্ণিত শাস্তিও আল্লাহ চাইলে কমিয়ে দিতে কিংবা মাফ করে দিতে পারেন। অন্যথায় আত্মহত্যাকারীর অপরাধটা এমনই যে,
সে চিরকালের জন্য জাহান্নামে যাওয়ার উপযুক্ত। (কিতাবুত তাওহিদ ২/৮৬৯)
২. আরবের পরিভাষায় خالدا مخلداশব্দ, যার অনুবাদ করা হয়,
‘চিরকাল’। মূলত এর দ্বারা আরবের লোকেরা কখনো কখনো দীর্ঘস্থায়ী অবস্থাকে বুঝিয়ে থাকেন। উক্ত হাদীসেও উদ্দেশ্যও দীর্ঘস্থায়ী হওয়া। চিরস্থায়ী হওয়া নয়। (আজইবা মুফিদাহ,
সুওয়াল নং ৩১১৭৪)
৩. হাদীসে যে বলা হয়েছে আত্মহত্যাকারী চিরদিন জাহান্নামে থাকবে,
তা ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে যে হালাল মনে করে আত্মহত্যা করেছে। কেননা আহলুসসুন্নাহ ওয়ালজামাতের নিকট যে কবিরা গোনাহকে বৈধ মনে করে সে কাফের হয়ে যাবে। আর কাফের তো চিরদিন জাহান্নামে থাকবে এতে কোন সন্দেহ নাই।(আদ্দুররুল মুখতার ২/১২৫)
তারপরও যে জিনিসটি আমাদের বুঝতে হবে,
আত্মহত্যা একটি কবীরা গুনাহ এবং কোন কবীরা গুনাহই কিন্ত শির্ক বা কুফরের সমান পাপ নয়।
আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত,মুসনাদে আহমাদে এসেছে যে,"আল্লাহ বলেছেনঃ
'হে আমার বান্দারা,তোমরা পৃথিবীপূর্ণ পাপ নিয়েও যদি আমার সাথে সাক্ষাত করতে আস,আমি পৃথিবীপূর্ণ ক্ষমা নিয়ে তোমার সাথে সাক্ষাত করব শুধু এই শর্তে যে,তুমি আমার সাথে কখনো শির্ক করো নি।'"।
অতএব,
কোন মুসলিম যদি আত্মহত্যা করেন,তাহলে তার ভাগ্য solely আল্লহর ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। যদি তিনি চান,ঐ ব্যক্তিকে মাফ করে দিতে পারেন,তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারেন,
আবার চাইলে তাঁকে শাস্তিও দিতে পারেন। আর সর্বশেষ কথা হলো যে,
আমরা কাউকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলার ক্ষমতা রাখিনা। এটা মহান আল্লহ কাল কিয়ামতের দিন নির্ধারন করবেন। তাই এই বিষয়টা মহান আল্লহর উপর ছেড়ে দেওয়াই সর্বোত্তম।
সর্বোপরি মহান আল্লহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
No comments:
Post a Comment