@- ইসলামিক দৃষ্টিতে চাঁদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা!!
[ পর্ব-০১/০৮ ]
চাঁদ দেখাই ধর্তব্য; জ্যোর্তিবিদদের হিসাব-নিকাশ নয়
প্রশ্ন: এখানে মুসলিম আলেমদের মধ্যে রমযানের রোযার শুরু ও ঈদুল ফিতর নির্ধারণ নিয়ে চরম মতভেদ। তাদের মধ্যে কেউ “চাঁদ দেখে রোযা রাখ ও চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গ” এ হাদিসের উপর নির্ভর করে চাঁদ দেখাকে ধর্তব্য মনে করেন। আর কেউ আছেন তারা জ্যোর্তিবিদদের মতামতের উপর নির্ভর করেন। তারা বলেন: বর্তমানে জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা মহাকাশ গবেষণার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছেন; তাদের পক্ষে চন্দ্র মাসের শুরু জানা সম্ভব। এ মাসয়ালায় সঠিক রায় কোনটি?
উত্তর:
আলহামদুলিল্লাহ।
এক:
সঠিক অভিমত হচ্ছে, যে অভিমতের ভিত্তিতে আমল করা কর্তব্য তা হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গ” যা প্রমাণ করছে তার ভিত্তিতে আমল করা। অর্থাৎ চর্মচোখে চাঁদ দেখে রমযান মাস শুরু করা ও রমযান মাস শেষ করা। কেননা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে শরিয়ত বা অনুশাসন দিয়ে পাঠানো হয়েছে সেটা কিয়ামত পর্যন্ত শ্বাশত ও অব্যাহত থাকবে। ইসলামী শরিয়ত সর্বকাল ও সর্বযুগের জন্য উপযোগী। হোক না, জাগতিক জ্ঞান অগ্রসর হোক; কিংবা অনগ্রসর থাকুক। হোক না যন্ত্রপাতি পাওয়া যাক; কিংবা না পাওয়া যাক। হোক না কোন দেশে জ্যোর্তিবিদ্যায় পারদর্শী বিজ্ঞানী থাকুক কিংবা না থাকুক। পৃথিবীর সর্বকালের, সর্বস্থানের মানুষ চাঁদ দেখে আমল করার সাধ্য রাখে। কিন্তু, জ্যোর্তিবদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তি কোথাও পাওয়া যেতে পারে; আবার কোথাও পাওয়া যাবে না। যন্ত্রপাতি হয়তো কোথাও পাওয়া যাবে; আবার হয়তো কোথাও পাওয়া যাবে না।
দুই:
জ্যোর্তিবিজ্ঞান কিংবা অন্যান্য বিজ্ঞানের যে বিকাশ ঘটেছে কিংবা ভবিষ্যতে ঘটবে নিশ্চয় আল্লাহ্ তাআলা সে ব্যাপারে জ্ঞাত আছেন। তা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তাআলা বলেন: সুতরাং তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি এই মাস পাবে সে যেন রোজা পালন করে।”[২ সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫] এ বিধানকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন যে, “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ; চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গ”[আল-হাদিস]। এর মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের রোযা শুরু করা ও রোযা ভঙ্গ করাকে চাঁদ দেখার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। নক্ষত্রের হিসাবের সাথে মাস গণনাকে সম্পৃক্ত করেননি। অথচ আল্লাহ্র জ্ঞানে রয়েছে যে, জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা অচিরেই নক্ষত্রের হিসাব ও বিচরণের জ্ঞানে এগিয়ে যাবেন। তাই মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহ্র রাসূলের মুখনিসৃত যে বিধান আল্লাহ্ দিয়েছেন সেটাকে গ্রহণ করা। তা হচ্ছে- চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোযা রাখা ও রোযা ভাঙ্গা। এটি আলেমদের ইজমার পর্যায়ে। যে ব্যক্তি এ অভিমতের বিপক্ষে গিয়ে নক্ষত্র গণনার উপর নির্ভর করবে তার অভিমতটি অসমর্থিত; এর উপর নির্ভর করা যাবে না।
আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
********************************************************************************
@- ইসলামিক দৃষ্টিতে চাঁদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা!!
[ পর্ব-০২/০৮ ]
তাঁরা দিনের বেলায় রমজান মাস শুরু হওয়ার খবর পেয়ে রোজা পালন করেছেন
প্রশ্ন: আমাদের কিছু মুসলিম ভাই সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত রমজান মাসের আগমন সম্পর্কে জানতে পারেননি। জানার পর থেকে তারা রোজা থেকেছেন। এই রোজা কি তাদের জন্য যথেষ্ট হবে, নাকি তাদেরকে এর বদলে কাযা রোজা রাখতে হবে?
উত্তর:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
সংবাদপ্রাপ্তির পর থেকে দিনের বাকি অংশ রোজা-ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থেকে তাঁরা সঠিক কাজটি করেছেন। তবে সেই দিনের বদলে তাদেরকে আরেকটি রোযা কাযা করতে হবে। [গবেষণা ও ফাত্ওয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র (১০/২৪৫)]
সেই দিনের পরিবর্তে আরেকটি রোজা কাযা করা ওয়াজিব হওয়ার কারণ হল, তারা রাত থেকে রোজার নিয়্যত করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
" من لم يُجمع الصيام قبل الفجر فلا صيام له "
“যে ব্যক্তি ফজরের পূর্ব হতে রোজার (ফরজ রোজা) নিয়্যত বাঁধেনি তার রোজা হবে না।” [মুসনাদে আহমাদ (৬/২৮৭), সুনানে আবু দাউদ (২৪৫৪), জামে তিরমিযি (৭৩০), সুনানে নাসাঈ (২৩৩১), আল-আলবানী ‘সহীহ আবু দাউদ’ (২১৪৩) গ্রন্থে হাদিসটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন]
********************************************************************************
@- ইসলামিক দৃষ্টিতে চাঁদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা!!
[ পর্ব-০৩/০৮ ]
যে কারাবন্দীর সময় জানার সুযোগ নেই তার নামায ও রোজা
প্রশ্ন: যে কারাবন্দী মাটির নীচে অন্ধকার সেলে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রয়েছে, নামাযের সময় জানার তার কোন সুযোগ নেই, রমজান মাস কখন শুরু হবে সে সম্পর্কে তার কাছে কোন তথ্য নেই সে কিভাবে নামায ও রোজা আদায় করবে?
উত্তর:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
এক:
আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন সকল মুসলিম বন্দীর আশু মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন, নিজ করুণায় তাদেরকে ধৈর্য্য-শক্তি ও সান্ত্বনা দান করেন, তাদের অন্তরগুলো আত্মপ্রশান্তি ও একীন দিয়ে ভরপুর করে দেন এবং মুসলিম উম্মাহকে সঠিক পথের দিশা দেন যে পথে তাঁর প্রিয়ভাজনগণ (আউলিয়াগণ) সম্মানিত হবেন এবং তাঁর শত্রুরা লাঞ্ছিত হবে।
দুই:
আলেমগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আটক ও কারাবন্দী ব্যক্তি সালাত ও সিয়াম এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে না। বরং তাদের উপর ফরজ হল সময় নির্ধারণে যথাসাধ্য চেষ্টা করা। যদি নামাযের সময় শুরু হয়েছে মর্মে প্রবল ধারণা হয়, তবে তিনি সালাত আদায় করে নিবেন। অনুরূপভাবে রমজান মাস শুরু হয়েছে মর্মে তার প্রবল ধারণা হলে তিনি রোজা পালন করবেন। খাবারের সময়গুলো খেয়াল করে অথবা কারাগারের লোকদের জিজ্ঞেস করে তিনি সময় নির্ধারণ করতে পারেন। তিনি যদি সালাত ও সিয়ামের সঠিক সময় জানার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন তবে তার ইবাদত সহিহ হবে ও এর মাধ্যমে তিনি দায়িত্ব মুক্ত হবেন; যদিও পরবর্তীতে তার কাছে প্রকাশ পায় যে, তার ইবাদত যথাসময়ে আদায় হয়েছে অথবা যথাসময়ের পরে আদায় হয়েছে অথবা কোন কিছু প্রকাশ না হোক। এর দলিল হচ্ছে- আল্লাহ তাআলার বাণী:
( لاَ يُكَلِّفُ اللّهُ نَفْساً إِلاَّ وُسْعَهَا ) [2 البقرة : 286]
“আল্লাহ কারো উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপান না।” [ ২ আল-বাক্বারাহ : ২৮৬ ]
এবং আল্লাহ তাআলার বাণী:
( لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْساً إِلَّا مَا آتَاهَا ) [65 الطلاق : 7]
“আল্লাহ যাকে যে পরিমাণ সামর্থ্য দান করেছেন এর অতিরিক্ত কোনো ভার তিনি তার উপর আরোপ করেন না।” [৬৫ সূরা আত্ব-ত্বালাক্ব : ৭]
তবে পরে যদি জানতে পারেন যে, তিনি ঈদের দিনগুলোতে রোজা ছিলেন তবে সে রোজাগুলো কাযা করা তার উপর ওয়াজিব। কারণ ঈদের দিনের রোজা সহিহ নয়। যদি পরবর্তীতে তিনি নিশ্চিতভাবে জানতে পারেন যে, তিনি সঠিক সময়ের পূর্বে সালাত বা সিয়াম পালন করেছেন তাহলে সে নামায পুনরায় আদায় করা ওয়াজিব।
আল- মূসূআ আল-ফিক্বহিয়্যাহ (২৮/৮৪-৮৫) গ্রন্থে রয়েছে:
“অধিকাংশ ফিকাহ-গবেষকের মতে, যার কাছে মাসের হিসাব সুস্পষ্ট নয় তিনি রমজানের রোজা পালনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবেন না। বরং রোজা পালন তার দায়িত্বে ফরজ হিসেবে থাকবে। যেহেতু তার উপর শরয়ি দায়িত্ব ন্যস্ত এবং তিনি শরয়ি নির্দেশের আওতাভুক্ত। তিনি যদি নিজের বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে রমজান মাস নির্ধারণে যথাসাধ্য চেষ্টা করে রোজা রাখা শুরু করেন এক্ষেত্রে তার পাঁচটি অবস্থা হতে পারে:
প্রথম অবস্থা:
অস্পষ্টতা অব্যাহত থাকা এবং সঠিক সময় তার নিকট পরিষ্ফুট না হওয়া। তার রোজা কি রমজান মাসে পালিত হয়েছে, নাকি রমজানের আগে পালিত হয়েছে, নাকি পরে পালিত হয়েছে এর কিছুই জানতে না পারা – এ ক্ষেত্রে তার পালিত রোজার মাধ্যমে তার দায়িত্ব খালাস হবে, তাকে পুনরায় রোজা রাখতে হবে না। যেহেতু তিনি সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছেন। অতএব, এর চেয়ে বেশি কিছু তার দায়িত্বে বর্তাবে না।
দ্বিতীয় অবস্থা :
বন্দি ব্যক্তির রোজা রমজান মাসে পালিত হওয়া- এই রোজার মাধ্যমে তার দায়িত্ব খালাস হবে।
তৃতীয় অবস্থা :
বন্দি ব্যক্তির রোজা পালন রমজানের পরে পালিত হওয়া- অধিকাংশ ফিক্বাহ বিশেষজ্ঞগণের মতে এই রোজা পালনের মাধ্যমে তার দায়িত্ব খালাস হবে।
চতুর্থ অবস্থা:
এর দু’টি দিক হতে পারে:
প্রথম দিক: তার রোজা রমজানের পূর্বে পালিত হওয়া এবং রমজান শুরু হওয়ার আগে তিনি তা জানতে পারা। এক্ষেত্রে রমজান মাস শুরু হলে তাকে রমজানের রোজা পালন করতে হবে এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। কারণ নির্ধারিত সময়ে তা পালন করার সামর্থ্য তার রয়েছে।
দ্বিতীয় দিক: তার রোজা রমজানের পূর্বে পালিত হওয়া এবং রমজান শেষ হওয়ার আগে তিনি তা জানতে না পারা। এই রোজা পালন তার দায়িত্ব খালাসের জন্য যথেষ্ট হবে কিনা এই ব্যাপারে দু’টি মত রয়েছে-
প্রথম মত: এই রোজা পালন তার দায়িত্ব খালাসের জন্য যথেষ্ট হবে না। বরং এর কাযা পালন করা তার উপর ওয়াজিব। এটি মালেকী, হাম্বলী মাযহাবের অভিমত এবং শাফেয়ী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য মতও এটি।
দ্বিতীয় মত: এই রোজা পালন রমজানের রোজা হিসেবে তার দায়িত্ব খালাসের জন্য যথেষ্ট হবে। যেমনিভাবে আরাফাতের দিন নির্ধারণের ব্যাপারে যদি সন্দেহ দেখা দেয় এবং হজ্জযাত্রীগণ আরাফার দিনের পূর্বেই আরাফাতে অবস্থান নেন তবে তাদের হজ্জ শুদ্ধ হবে – এটি শাফেয়ি মাযহাবের কিছু কিছু আলেমের অভিমত।
পঞ্চম অবস্থা:
“তার কিছু রোযা রমজান মাসে এবং কিছু রোজা রমজানের পরে পালিত হওয়া। যে রোজাগুলো রমজান মাসে অথবা রমজানের পরে পালিত হয়েছে সেগুলো তার দায়িত্ব খালাসের জন্য যথেষ্ট হবে। আর যে রোজাগুলো রমজান মাসের আগে পালিত হয়েছে সেগুলো তার দায়িত্ব খালাসের জন্য যথেষ্ট জন্য হবে না।” সমাপ্ত
দেখুন- আল-মাজমূ (৩/৭২-৭৩), আল-মুগনী (৩/৯৬)
আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
******************************************************************************
@- ইসলামিক দৃষ্টিতে চাঁদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা!!
[ পর্ব-০৪/ ০৮]
প্রশ্ন: আমাদের দেশে একদল দ্বীনদার ভাই আছেন তারা কিছু কিছু ব্যাপারে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেন। যেমন রমজান মাসের সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে তারা খালি চোখে নতুন চাঁদ না-দেখা পর্যন্ত সিয়াম পালন করেন না। কখনও কখনও আমরা তাদের একদিন বা দুইদিন আগে রমজানের সিয়াম পালন শুরু করি। তারাও ঈদুল ফিতরের একদিন বা দুইদিন পরে ঈদ উদযাপন করে থাকেন। আমরা যদি তাদেরকে ঈদের দিনে রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি তারা এই বলে জবাব দেন যে, আমরা খালি চোখে নতুন চাঁদ না-দেখা পর্যন্ত ঈদ করব না এবং রোজা রাখা শুরু করব না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখে সিয়াম পালন কর এবং তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা ছাড়।” তারা যন্ত্রের সাহায্যে নতুন চাঁদ দেখার পদ্ধতি মানেন না। উল্লেখ্য দুই ঈদের নামাযের সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তারা আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেন। তারা তাদের নতুন চাঁদ দেখার ভিত্তিতে স্থানীয়ভাবে ঈদ উদযাপনের পরে ঈদ উদযাপন করেন। অনুরূপভাবে তারা ঈদুল আযহার সময় পশু কোরবানী ও আরাফার সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রেও আমাদের বি করেন। তারা ঈদুল আযহার দুইদিন পরে ঈদ উদযাপন করেন। অর্থাৎ সমস্ত মুসলিম কোরবানী করার পরে তারা পশু কোরবানী করেন। তারা যা করছেন তা কি সঠিক? আল্লাহ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন।
উত্তর:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
তাদের উপর ওয়াজিব হল সমস্ত পৃথিবীর সাধারণ মানুষের সাথে সিয়াম পালন করা, তাদের সাথে ঈদ উদযাপন করা এবং তাদের সাথে দুই ঈদের নামায আদায় করা। এর দলীল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী:
« صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته فإن غم عليكم فأكملوا العدة » متفق عليه
“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখে সিয়াম পালন কর, তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা ছাড় (ঈদ উদযাপন কর)। আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে (রোজার) সংখ্যা (৩০ দিন) পূর্ণ কর।” [সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম] এই হাদিসের উদ্দেশ্য হলো- চাঁদ দেখা সাব্যস্ত হলে সিয়াম পালন ও ঈদ উদযাপনের আদেশ দেয়া। সেটা খালি চোখেও হতে পারে অথবা দৃষ্টিশক্তিকে সাহায্যকারী কোন যন্ত্রপাতির মাধ্যমেও হতে পারে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
" الصوم يوم تصومون والإفطار يوم تفطرون والأضحى يوم تضحون "
أخرجه أبو داوود (2324) والترمذي (697) ، وصححه الألباني في صحيح الترمذي ( 561 )
“রোজা হল সেদিন যেদিন তোমরা সকলে রোজা পালন কর। ঈদ হল সেদিন যেদিন তোমরা সকলে ঈদ উদযাপন কর। ঈদুল আযহা হলো সেদিন যেদিন তোমরা সকলে পশু কোরবানী কর।’’[হাদিসটি আবু দাউদ (২৩২৪) ও তিরমিযী (৬৯৭) বর্ণনা করেছেন; আলবানী সহীহুত তিরমিযী’ (৫৬১) গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
আল্লাহই তাওফিক দাতা। আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সাহাবীগণের উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।
******************************************************************************
@- ইসলামিক দৃষ্টিতে চাঁদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা!!
[ পর্ব-০৫/ ০৮ ]
নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে যার কথা গ্রহণযোগ্য কে সেই আদল ব্যক্তি
প্রশ্ন: আমি (1584) নং প্রশ্নের উত্তরে পড়েছি যে, রমজান মাসের শুরু প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রে একজন আদল ও ছিকা ব্যক্তির চাঁদ দেখা যথেষ্ট। সে আদল ব্যক্তির পরিচয় কি?
উত্তর:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
আদল (عَدْل) এর শাব্দিক অর্থ মুস্তাক্বীম (সরল, সোজা)। এটি বক্রতার বিপরীত।
শরিয়তের পরিভাষায়: আদল হলেন সেই ব্যক্তি যিনি সমস্ত ফরজ পালন করেন, কোন কবিরা গুনাতে লিপ্ত নন এবং উপর্যুপরি সগিরা গুনাতেও লিপ্ত নন।
ফরজ পালন করার অর্থ হল- ফরজ ইবাদতসমূহ আদায় করা। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায।
কবিরা গুনাহ না করার অর্থ- নামিমাহ্ (চোগলখুরী), গিবত (অপরের অগোচরে পরনিন্দা) ইত্যাদি কবিরা গুনাহ না করা।
সেই ব্যক্তির মধ্যে আদল হওয়ার সাথে সাথে আরো যে শর্ত থাকতে হবে তা হলো:
সেই ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি প্রখর হতে হবে। যাতে করে তার দাবীর সত্যতার পক্ষে সম্ভাবনা বেশি থাকে। দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হলে আদল হওয়া সত্ত্বেও তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হওয়ায় তার সাক্ষ্যে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। এই শর্তটির পক্ষে দলীল হলো- আল্লাহ তাআলা কোন কাজের দায়িত্ব দেয়ার জন্য শক্তি ও আমনতদারিতাকে উপযুক্ত বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন। মূসা আলাইহিস সালামের সাথে মাদইয়ানের (এক বৃদ্ধ) অধিবাসীর কাহিনীতে তার দুই মেয়ের একজন বলেছিলেন:
{ يا أبت استأجره إن خير من استأجرت القوي الأمين } [28 القصص : 26]
“আব্বু, ইনাকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজে নিয়োগ করুন। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কারও থেকে কাজ নিতে চাইলে এমন ব্যক্তিই উত্তম যে শক্তিশালী ও আমানতদার।” [২৮ সূরা আল-ক্বাসাস: ২৬] ইফরিত নাম্নী যে জ্বিন সাবা রাজ্যের রানীর সিংহাসন উঠিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে বলেছিল:
{ وإني عليه لقوي أمين } [27 النمل : 39]
“এবং নিশ্চয়ই আমি এ ব্যাপারে শক্তিবান ও আমানতদার।”[২৭ সূরা আন নাম্ল : ৩৯]
তাই (শক্তি ও আমানতদারিতা) এ দুইটি গুণ থাকা যে কোন দায়িত্বপ্রাপ্তির প্রধান দুটি শর্ত। সাক্ষ্য প্রদানও এমনি একটি গুরু দায়িত্ব। [আশ-শার্হ আল-মুমতি‘ (৬/৩২৩)] আরও জানতে দেখুন আল-মূসূ‘আহ আল-ফিক্বহিয়্যাহ (ফিক্বহী এনসাইক্লোপিডিয়া) (৫/৩০),
*************************************************************************
@- ইসলামিক দৃষ্টিতে চাঁদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা!!
[ পর্ব-০৬/ ০৮ ]
চাঁদ উঠার বিভিন্ন উদয়স্থল সংক্রান্ত মতভেদ কি বিবেচনাযোগ্য? এ ব্যাপারে অমুসলিম দেশে অবস্থানরত মুসলিম কমিউনিটির করণীয়
প্রশ্ন: আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে বসবাসরত কিছু মুসলিম ছাত্র। প্রতি বছর রমজান মাসের শুরুতে আমরা একটি সমস্যার মুখোমুখি হই। এ সময় স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটি তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১. প্রথম দল: তারা যে দেশের স্থায়ী বাসিন্দা সে দেশে চাঁদ দেখার খবরের ভিত্তিতে রোজা শুরু করে। ২. দ্বিতীয় দল: যারা সৌদি আরবে রোজা রাখা শুরু হলে সিয়াম পালন শুরু করে। ৩. তৃতীয় দল: যারা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মুসলিম ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নতুন চাঁদ দেখার খবর পৌঁছলে রোজা রাখে। এ ছাত্র ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে চাঁদ দেখার দায়িত্ব পালন করে থাকে। তারা দেশের কোন এক স্থানে চাঁদ দেখলে সে খবর বিভিন্ন ইসলামিক সেন্টারে পৌঁছে দেয়। তাদের খবরের ভিত্তিতে গোটা যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমান একই দিন রোজা পালন শুরু করে; যদিও শহরগুলোর মাঝে দূরত্ব অনেক। এক্ষেত্রে সিয়াম পালন, চাঁদ দেখা ও এ সংক্রান্ত খবরের ব্যাপারে কারা বেশি অনুসরণযোগ্য? দয়া করে এ ব্যাপারে আমাদেরকে ফতোয়া দিন; আল্লাহ আপনাদেরকে সওয়াব দিবেন।
উত্তর:
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
এক:
স্থানভেদে নতুন চাঁদের ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল থাকার বিষয়টি ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি দ্বারা অবধারিতভাবে জ্ঞাত। এ ব্যাপারে কোন আলেম দ্বিমত করেন নি। সে ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল কি বিবেচনাযোগ্য; নাকি বিবেচনাযোগ্য নয়- তা নিয়ে আলেমগণ মতভেদ করেছেন।
দুই:
ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল ও তা বিবেচনাযোগ্য না হওয়ার বিষয়টি তাত্ত্বিক মাসয়ালা। এতে ইজতিহাদের সুযোগ রয়েছে। ইলম ও দ্বীনদারির বিবেচনায় যোগ্য আলেমদের এ ব্যাপারে মতভেদ করার অবকাশ আছে। এটি এমন একটি গ্রহণযোগ্য মতভেদ যে ব্যাপারে সঠিক মত প্রদানকারী (মুজতাহিদ) দুইবার সওয়াব পাবেন- ইজতিহাদ করার সওয়াব ও সঠিক মত প্রদান করার সওয়াব এবং ভুল মত প্রদানকারী (মুজতাহিদ)ও ইজতিহাদ করার জন্য একটি সওয়াব পাবেন।
এই মাসয়ালাতে আলেমগণ দুটি মত ব্যক্ত করেছেন:
-তাঁদের কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করেছেন
-আর কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করেননি
তাদের উভয়পক্ষ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দলিল দিয়েছেন। এমনকি একই দলিল উভয় পক্ষ তার মতের পক্ষে ব্যবহার করেছেন। কারণ সে দলিলটি উভয় মতের পক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করা যায়। যেমন আল্লাহ্র তাআলার বাণী:
( يسألونك عن الأهلة قل هي مواقيت للناس والحج ) [ 2 البقرة: 189]
“লোকেরা আপনাকে নতুন মাসের চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি তাদেরকে বলে দিন এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজ-কর্মের) এবং হজ্জের সময় নির্ধারণ করার জন্য।” [২ সূরা আল-বাক্বারা:১৮৯] এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী:
( صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته ) الحديث
“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা শুরু কর এবং সেটা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা ছেড়ে দাও।”[সহিহ বুখারী(১৯০৯)ও সহিহ মুসলিম (১০৮১)] উভয় পক্ষের এ মতভেদের কারণ হল প্রত্যেক পক্ষ দলিলটিকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বুঝেছেন এবং মাসয়ালা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা পথ অনুসরণ করেছেন।
তিন:
জ্যোতির্বিদ্যার গণনার মাধ্যমে নতুন চাঁদ সাব্যস্তকরণ ও এ ব্যাপারে বর্ণিত কুরআন-হাদিসের দলিলগুলো আলেমগণের পরিষদ পর্যালোচনা করেছেন এবং তাঁরা এ ব্যাপারে পূর্ববর্তী আলেমগণের সকল বক্তব্য অবগত হয়েছেন। পরিশেষে তাঁরা সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, শরয়ি বিধিবিধান পালনের জন্য নতুন চাঁদ সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁদের দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী:
( صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته ) الحديث
“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা রাখ এবং তা (নতুন চাঁদ) দেখে রোজা ছাড়।” [সহিহ বুখারী (১৯০৯) ও সহিহ মুসলিম (১০৮১)] তিনি আরো বলেছেন:
(لا تصوموا حتى تروه ولا تفطروا حتى تروه ) الحديث
“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) না-দেখা পর্যন্ত রোজা রেখো না এবং তা (নতুন চাঁদ) না-দেখা পর্যন্ত রোজা ছেড়ে দিও না।”[মালিক (৬৩৫)] এবং এই অর্থের আরো অন্যান্য দলীল।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো বিশ্বের যেকোন প্রান্তের চাদ উদয়ের সংবাদ নির্ভরযোগ্যভাবে পাওয়া মাত্রই সকল মুসলিমের জন্য় সিয়াম ও ঈদ পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
*********************************************************************************
@- ইসলামিক দৃষ্টিতে চাঁদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা!!
[ পর্ব-০৭/ ০৮ ]
যে ব্যক্তি একাকী রমজান মাসের নতুন চাঁদ দেখেছে তার জন্য কি সিয়াম পালন করা অনিবার্য?
প্রশ্ন: যে ব্যক্তি একাকী রমজান মাসের নতুন চাঁদ দেখেছে তার জন্য কি সিয়াম পালন করা অনিবার্য? যদি তা অনিবার্য হয় এর সপক্ষে দলীল কী?
উত্তর :
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
যে ব্যক্তি রমজান মাসের নতুন চাঁদ অথবা শাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ একাই দেখেছে এবং এ ব্যাপারে বিচারককে অথবা স্থানীয় লোকজনকে অবহিত করেছে কিন্তু তারা তার সাক্ষ্য গ্রহণ করেনি তবে কি সে একাই রোজা পালন করবে? নাকি সবার সাথে রোজা পালন করবে-এ ব্যাপারে আলেমগণের মাঝে তিনটি অভিমত রয়েছে:
প্রথম মত:
সে ব্যক্তি মাসের শুরু ও সমাপ্তি উভয় ক্ষেত্রে তার নিজের দেখা অনুসারে একাকী আমল করবে। মাসের শুরুতে তিনি একাকী রোজা শুরু করবেন এবং মাসের শেষে নিজের দেখা অনুযায়ী রোজা ছাড়বেন। এটি ইমাম শাফেয়ীর অভিমত।
তবে তিনি তা গোপনে করবেন। প্রকাশ্যে মানুষের বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত হবেন না। যাতে মানুষ তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা না করে। কারণ এক্ষেত্রে রোজাদারগণ তাকে বে-রোজদার মনে করবে।
দ্বিতীয় মত :
সে ব্যক্তি নিজের দেখা অনুসারে মাসের শুরুতে আমল করবেন এবং একাকী রোজা রাখা শুরু করবেন। তবে মাসের শেষে নিজের দেখা অনুসারে আমল করবেন না। বরং অন্য সবার সাথে রোজা ছাড়বেন করবে। এদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ রাহিমাহুমুল্লাহ।
আর এ মতটি গ্রহণ করেছেন শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ। তিনি বলেছেন: “এটি সাবধানতামূলক অভিমত। এ মত গ্রহণের মাধ্যমে আমরা রোজা থাকা ও ছাড়া উভয় ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করেছি। রোজা পালনের ক্ষেত্রে আমরা তাকে বলব: আপনি রোজা রাখুন। কিন্তু রোজা ছাড়ার ব্যাপারে আমরা তাকে বলব: আপনি রোজা ছাড়বেন না; বরং রোজা রাখতে থাকুন।” সমাপ্ত [আশ-শারহুল মুমতি (৬/৩৩০)]
তৃতীয় মত :
সে ব্যক্তি মাসের শুরু অথবা সমাপ্তি কোন ক্ষেত্রে তার নিজের দেখা অনুসারে আমল করবে না। বরং সবার সাথে রোজা রাখবে এবং সবার সাথে রোজা ছাড়বে।
এক বর্ণনামতে এ অভিমতের পক্ষে রয়েছেন ইমাম আহমাদ। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ এ মতটিকে সমর্থন করেছেন এবং এর সপক্ষে অনেক দলীল পেশ করেছেন। তিনি বলেন: “আর তৃতীয় মত হচ্ছে- সে ব্যক্তি অন্য সব মানুষের সাথে রোজা রাখবেন এবং সবার সাথে রোজা ছাড়বেন। উল্লেখিত মতগুলোর মধ্যে এ মতটি বেশি শক্তিশালী। এর পক্ষে দলীল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী: “আপনাদের রোজা হবে সেদিন, যেদিন আপনারা সকলে রোজা রাখেন এবং আপনাদের ঈদ হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে ঈদ উদযাপন করেন। আর আপনাদের ঈদুল আযহা হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে পশু কোরবানী করেন।’’[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তিরমিযী এবং তিনি বলেছেন: হাদিসটি হাসান-গরীব, এটি আরও বর্ণনা করেছেন আবু দাউদ এবং ইবনে মাজাহ। তিনি শুধু ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। এবং ইমাম তিরমিযী আব্দুল্লাহ ইবনে জাফরের সূত্রে উসমান ইবনে মুহাম্মদ হতে, তিনি আলমাকবুরি হতে, তিনি আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “রোজা হল সেদিন যেদিন আপনারা সকলে রোজা পালন করেন। ঈদুল ফিতর (রোজা ভঙ্গের ঈদ) হল সেদিন যেদিন আপনারা সকলে রোজা ভঙ্গ করেন। আর ঈদুল আযহা হল সেদিন যেদিন আপনারা সকলে পশু কোরবানী করেন।’’ তিরমিযী বলেন: এই হাদিসটি হাসান-গরীব। তিনি আরো বলেন: ‘আলেমগণের মধ্যে অনেকে এই হাদিসটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: এর অর্থ হল- রোজা শুরু করতে হবে ও ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে হবে সম্মিলিতভাবে, সকল মানুষের সাথে।” সমাপ্ত [মাজমূউল ফাতাওয়া (২৫/১১৪)]
তিনি আরও দলীল হিসেবে পেশ করেন যে, কেউ যদি জিলহজ্ব মাসের নতুন চাঁদ একাকী দেখে তবে আলেমগণের কেউ একথা বলেননি যে, (হজ্জ পালনের ক্ষেত্রে) সে একাকী আরাফাতে অবস্থান করবে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, এই মাসয়ালার মূলভিত্তি হচ্ছে- আল্লাহ তাআলা এই হুকুমকে নতুন চাঁদ ও মাসের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। তিনি বলেন:
( يسألونك عن الأهلة قل هي مواقيت للناس والحج )
“লোকেরা আপনাকে নতুন মাসের চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি তাদেরকে বলে দিন এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজ-কর্মের) এবং হজ্জের সময় নির্ধারণ করার জন্য।”[২ সূরা আল-বাক্বারা:১৮৯] আয়াতে কারীমাতে আহিল্লাহ (أهلة) শব্দটি হিলাল (هلال) শব্দের বহুবচন। হিলাল বলতে বুঝায়- যা দিয়ে কোন ঘোষণা দেয়া হয় বা কোন কিছু প্রচার করা হয়। তাই আকাশে যদি চাঁদ উদিত হয় আর মানুষ সে সম্পর্কে না জানে এবং তা দিয়ে মাস গণনা শুরু না করে তবে তো তা ‘হিলাল’ হলো না। অনুরূপভাবে شهر(শাহর বা মাস) শব্দটি شهرة (শুহরত বা প্রসিদ্ধি) শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সুতরাং মানুষের মাঝে যদি প্রসিদ্ধি না পায় তবে তো নতুন মাস শুরু হয়েছে বলে গণ্য করা হবে না। অনেক মানুষ এই মাসয়ালাতে ভুল করেন এই ধারণার কারণে যে, তারা মনে করেন আকাশে নতুন চাঁদ উদিত হলেই তো তা মাসের প্রথম রাত্রি হিসেবে ধরা হবে- চাই সেটা মানুষের মাঝে প্রচার লাভ করুন অথবা না করুক, তারা এর দ্বারা নতুন মাস গণনা আরম্ভ করুক বা না করুক। কিন্তু ব্যাপারটি এমন নয়; বরং মানুষের কাছে নতুন চাঁদ প্রকাশিত হওয়া এবং এর দ্বারা তাদের নতুন মাস শুরু করা আবশ্যক। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
( صومكم يوم تصومون ، وفطركم يوم تفطرون ، وأضحاكم يوم تضحون )
“আপনাদের রোজা হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে রোজা পালন শুরু করেন। আপনাদের ঈদ হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে রোজা ভঙ্গ করেন। আর আপনাদের ঈদুল আযহা হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে পশু কোরবানী করেন।’’ অর্থাৎ যেদিনটিকে আপনারা রোজা পালন, ঈদুল ফিতর উদযাপন এবং ঈদুল আযহা উদযাপনের দিন হিসেবে জানতে পেরেছেন। আর যদি আপনারা তা না-জানতে পারেন তবে এ কারণে আপনাদের উপর কোন হুকুম বর্তাবে না।” সমাপ্ত [মাজমূল ফাতাওয়া (২৫/২০২)]
এই মতানুযায়ী ফতোয়া দিয়েছেন শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায [মাজমূ ফাতাওয়া আশ-শাইখ (১৫/৭২)]
وحديث : ( الصوم يوم تصومون...) صححه الألباني رحمه الله في صحيح سنن الترمذي برقم (561)
“রোজা হবে সেদিন যেদিন আপনারা সকলে রোজা পালন শুরু করেন...’’ হাদিসটিকে আলবানী সহীহ সুনানে তিরমিযি গ্রন্থে সহীহ বলে চিহ্নিত করেছেন (৫৬১)।
আরও দেখুন ফিকাহবিদগণের মতামত- আল মূগনী (৩/৪৭, ৪৯), আল মাজমূ (৬/২৯০), আল-মাওসুআ আল-ফিক্বহিয়্যাহ (১৮/২৮)]
আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন
******************************************************************************
@- ইসলামিক দৃষ্টিতে চাঁদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা!!
[ পর্ব-০৮/ ০৮ ]
নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে টেলিস্কোপ জাতীয় যন্ত্রপাতির সাহায্য নেয়া জায়েয; জ্যোতির্বিজ্ঞানের গণনার সাহায্য নয়
প্রশ্ন: নতুন চাঁদের বয়স ৩০ ঘণ্টা হওয়ার আগে খালি চোখে তা দেখা সম্ভব নয়। এছাড়া কখনো আবহাওয়াজনিত কারণে তা দেখা সম্ভব হয় না। এর উপর ভিত্তি করে কি অ্যাসট্রনমিক্যাল তথ্যাদির সাহায্যে নতুন চাঁদ দেখার সম্ভাব্য সময় ও রমজান মাস শুরু হওয়ার সময় হিসাব করা জায়েয? নাকি পবিত্র রমজান মাস শুরু করার আগে নতুন চাঁদ দেখা আমাদের উপর ওয়াজিব?
উত্তর:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
নতুন চাঁদ দেখার জন্য দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য নেয়া জায়েয। কিন্তু পবিত্র রমজান মাসের শুরু সাব্যস্ত করা কিংবা ঈদের দিন নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করা জায়েয নয়।
কারণ আল্লাহ তাঁর কিতাবে কিংবা তার নবীর হাদিসে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করা আমাদের জন্য শরিয়তসিদ্ধ করেন নি। বরং আমাদের জন্য চাঁদ দেখাকে শরিয়তসিদ্ধ করেছেন। রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেলে রোজা শুরু করা এবং শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে রোজা ছাড়া এবং ঈদুল ফিত্বরের নামাযের জন্য মিলিত হওয়াকে শরিয়তসিদ্ধ করেছেন। মানুষের কাজ কর্মের হিসাব নির্ণয় ও হজ্জের সময় নির্ণয়ক বানিয়েছেন চন্দ্রকে। তাই কোনো মুসলিমের জন্য এ পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমে ইবাদতের সময়সীমা নির্ধারণ করা জায়েয নয়। যেমন- রমজান মাসের রোজা, ঈদ উদযাপন, বায়তুল্লার হজ্জ আদায়, ভুলক্রমে হত্যার কাফ্ফারার রোজা, যিহারের কাফ্ফারার রোজা ইত্যাদি।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
قال تعالى : ( فمن شهد منكم الشهر فليصمه ) [2 البقرة : 185]
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই মাস পেলো সে যাতে সিয়াম পালন করে।”[২ আল-বাক্বারাহ:১৮৫] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:
( يسألونك عن الأهلة قل هي مواقيت للناس والحج) [2 البقرة : 189]
“তারা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, বলুন তা মানুষের (কাজ-কর্ম) ও হজ্জ এর জন্য সময় নির্ধারক।” [২ আল-বাক্বারাহ : ১৮৯] এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
( صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته فإن غم عليكم فأكملوا العدة ثلاثين )
“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখে সিয়াম পালন কর এবং তা (নতুন চাঁদ) দেখে ঈদ কর। আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় তবে ৩০ দিন পূর্ণ কর।”
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, যারা চন্দ্রের উদয়স্থলে পরিষ্কার আকাশে অথবা মেঘাচ্ছন্ন আকাশে নতুন চাঁদ দেখতে পেলো না তাদের জন্য শাবান মাস ত্রিশদিন পূর্ণ করা ওয়াজিব।”[ফাতাওয়াল্ লাজনাহ আদ্দায়িমা (ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র) (১০/১০০ ]
যদি পার্শ্ববর্তী অন্য কোন অঞ্চলে নতুন চাঁদ দেখা প্রমাণিত না হয় তাহলে এই হুকুম প্রযোজ্য। আর যদি অন্য অঞ্চলে শরিয়তসম্মতভাবে নতুন চাঁদ দেখা প্রমাণিত হয় তাহলে অধিকাংশ আলেমের মতানুযায়ী তাদের উপর সিয়াম পালন করা ওয়াজিব।
আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
No comments:
Post a Comment