Monday, October 21, 2019

ঘুষের ভয়াবহতা ও তা থেকে উত্তরণের উপায় কি?

🔘🔘🔘 ঘুষের ভয়াবহতা ও তা থেকে উত্তরণের উপায় 🔘🔘🔘
ঘুষ একটি সামাজিক ব্যাধি। ঘুষ হচ্ছে স্বাভাবিক ও বৈধ উপায়ে যা কিছু পাওয়া যায় তার উপর অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা। কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়মিত বেতন/ভাতা পাওয়া সত্ত্বেও যদি বাড়তি কিছু অবৈধ পন্থায় গ্রহণ করে তাহলে তা ঘুষ হিসাবে বিবেচিত। অনেক সময় স্বীয় অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ঘুষ দেওয়া হয়। আবার অনেক সময় টাকা-পয়সা ছাড়াও উপহারের নামে নানা সমগ্রী প্রদান করা হয়। সুতরাং যেভাবেই হোক, আর যে নামেই হোক তা ঘুষের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي»
“ঘুষ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ের উপরই আল্লাহর লা‘নত[1]।”
সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পদে থেকে হারাম অর্থ গ্রহণই হচ্ছে ঘুষ। এই ঘুষ যারা দেয় তারাও সমান অপরাধী। বেআইনী ফায়দা হাসিলের জন্য যারা কর্তাব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন সুবিধা বা টাকা পয়সা দিয়ে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে তারাই এই গুনাহ সংঘটনের অন্যতম শরীক। যারা ঘুষকে একটি অঘোষিত ব্যবস্থা হিসেবে প্রশ্রয় দেয় তারাই অপরাধী। দেখা যায় মাঝে মধ্যে বেড়াই ক্ষেত খায়, রক্ষকই হয় ভক্ষক। ন্যায়কে যাদের লালন করার কথা তারাই অন্যায়কে ধারণ করছে। এভাবে দুর্নীতির ডালপালা সারা দেশে বিস্তার লাভ করে।
ঘুষ বা উৎকোচ আসে নজরানার রূপ ধরে। “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন সাহাবীকে কর্মচারী নিয়োগ করে যাকাত আদায়ের জন্য পাঠালেন। সে ফিরে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, এটা যাকাতের মাল আর এটা আমাকে উপঢৌকনস্বরূপ দেওয়া হয়েছে। এতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন- সরকারী কর্মচারীর কি হলো! আমরা যখন তাকে কোনো দায়িত্ব দিয়ে কোথায়ও প্রেরণ করি তখন সে ফিরে এসে বলে এই মাল আপনাদের (সরকারের) এবং এটা আমাকে প্রদত্ত উপহার। সে তার বাড়িতে বসে থেকে দেখুক তাকে উপহার দেওয়া হয় কি-না[2]।”
একবার এক সরকারী উর্ধ্বতন কর্মকর্তা উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-কে কিছু উপহার দিলেন। উপহারগুলো দেখে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছিলেন- তুমি যে বললে এগুলো বায়তুলমালের আর এগুলো আমার উপহার! তুমি এই পদ ছেড়ে বাপের ঘরে বসে থাক, দেখ তো কে তোমার জন্য উপহার নিয়ে আসে।” সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করার এই জ্ঞান ও সাহসের জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আল-ফারুক উপাধি দিয়েছিলেন। কবি ফররুখ বলেছেন-
“আজকে উমর পন্থী পথিক দিকে দিকে প্রয়োজন
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণপণ।”
কিন্তু হায়! এখন মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের এই সমাজের চিত্র দেখলে প্রশ্ন জাগে ইসলামের সেই মহান শিক্ষার প্রতিফলন কোথায়? এ জন্যেই কবি নজরুল বলেছেন:
ইসলাম সে তো পরশ মানিক তারে কে পেরেছে খুঁজি,
পরশে তাহার ধন্য যারা তাদেরই আমরা বুঝি।
ইসলামের পরশ আমাদের কলবে পৌঁছেনি বলেই আজ আমরা ঘুষকে উপহার ভাবি। অফিসের ফাইল ঘুষ না পেলে সামনে চলে না। যার ফলে দেশ ও জাতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয় না। কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে মেধাহীনদের রাজত্ব চলে। ঘুষ দিয়ে যে চাকুরী পেতে হয় সেই চাকুরীকে সেবা মনে করার কোনো কারণ নেই। আর তাই ঘুষ দিয়ে শিক্ষকের চাকুরী পাওয়া লোকটির কাছ থেকে তার ছাত্ররা কতটুকু এলেমদার হবে তা নিয়ে মনে অনেক সংশয় থেকে যায়।
এই ঘুষের জামানায় পাকা দড়িবাজরা তরতর করে উপরে উঠে যাচ্ছে দেখে আল্লাহর নেক বান্দারা মাঝে মাঝে ভাবে, যে কি নেক নিয়তের কি কোনো দাম নেই? এটা কি বোকামি? কিন্তু তিতা ফলের চারা লাগিয়ে যেমন সুমিষ্ট ফলের আশা করা যায় না তেমনি দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে উঠা ব্যবস্থাপনার কাছে কোনো কল্যাণ আশা করা যায় না। তাই ঘুষ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:
﴿فَبَدَّلَ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ قَوۡلًا غَيۡرَ ٱلَّذِي قِيلَ لَهُمۡ فَأَنزَلۡنَا عَلَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ رِجۡزٗا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ بِمَا كَانُواْ يَفۡسُقُونَ ﴾ [البقرة: ٥٩]
“এরপর যালিমরা বদলে দিল যা তাদের বলা হয়েছিল। তার পরিবর্তে অন্য কথা। এ কারণে যারা যুলুম করল তাদের উপর নাযিল করলাম আকাশ হতে এক মহাশাস্তি। কারণ, তারা অধর্ম-অন্যায় কাজ করেছিলো।” (আল-কুরআন, ২:৫৯)
এ আয়াতে সত্যকে বদলে দেওয়ার শাস্তির উল্লেখ আছে। ঘুষও সত্যকে বদলে দেয়। পাসকে ফেল দেখিয়ে দেয়। একজন হকদারের হক বদলে দিয়ে অন্যকে অন্যায়ভাবে দেওয়া হয়।
অতীত যামানায় যারা ঘুষ গ্রহণ করত, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ধর্মের বাণীতে জালিয়াতি করত তাদের সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে:
﴿ فَوَيۡلٞ لِّلَّذِينَ يَكۡتُبُونَ ٱلۡكِتَٰبَ بِأَيۡدِيهِمۡ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ لِيَشۡتَرُواْ بِهِۦ ثَمَنٗا قَلِيلٗاۖ فَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتۡ أَيۡدِيهِمۡ وَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا يَكۡسِبُونَ ٧٩ ﴾ [البقرة: ٧٩]
সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছ মূল্য প্রাপ্তির জন্য বলে- এটি আল্লাহর নিকট হতে এসেছে। তাদের হাত যা রচনা করেছে তার জন্য শাস্তি তাদের এবং যা তরা উপার্জন করে তার জন্যও শাস্তি তাদের।” (আল-কুরআন, ২:৭৯)
ঘুষ হচ্ছে একটি হারাম জিনিস। যদিও ঘুষখোর এটাকে হারাম মনে করে না। আয়াতে ঘুষ খেয়ে ধর্মের বাণী বদলে দেওয়ার কথা বলা হলেও সকল জালিয়াতির জন্যই শাস্তি প্রযোজ্য।
ঘুষ সব সময় টাকা-পয়সা হয় না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানান বস্তু ও বিষয় হতে পারে। এ জন্যই হাদীসের ভাষায় এটিকে বলে ‘রিশওয়াহ’ বা দড়ি। দড়ি দিয়ে কুপের ভেতর থেকে বালতি টেনে উঠাবার মত ঘুষ অন্যের হক নিজের ঘরে নিয়ে আসে। এজন্য এই প্রক্রিয়ায় তিনটি পক্ষ থাকে।
১. রাশী راشى যে ঘুষ প্রদান করে,
২. মুরতাশী مرتشى যে ঘুষ গ্রহণ করে এবং
৩. রায়েশ رائش যে অনুঘটক হয়ে কাজ করে। আল্লামা সান‘আনী তার বিখ্যাত গ্রন্থ সুবুলুস সালাম শারহু বুলুগিল মারাম গ্রন্থে বলেন- রায়েশ বা ঘুষের ঘটক হচ্ছে্ ওই ব্যক্তি যে ঘুষখোর ও ঘুষদাতার মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে থাকে।[3]
তবে মূলপক্ষ হচ্ছে দুটি: যে ঘুষ দেয় ও যে ঘুষ খায়।
আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لعنة الله االراشي والمرتشي في الحكم »
“ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের ওপর আল্লাহর লা’নত।”[4]
ইমাম তাবারানী তার আল-মু‘জামুস সগীর গ্রন্থে একটি হাদীস সংকলন করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« الرشوة في الحكم كفر وهى بين الناس سحت»
‘রিশওয়াহ বিচারের ক্ষেত্রে কুফরি। লোকেরা নিজেদের মধ্যে এ কাজ করা সুহত।”
আগেই বলা হয়েছে রিশওয়াহ অর্থ ঘুষ। তাহলে সুহত অর্থ কি? এ প্রশ্নের উত্তর পাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীসে:
«كل لحم أنبتته السحت فالنار أولى به، قيل ما السحت ؟ قال الرشوة في الحكم»
“যে গোশত উদগত হয়েছে সুহত থেকে, তার জন্য জাহান্নামের আগুনই বেশি উপযোগী। একজন জিজ্ঞেস করলো, সুহত কী? তিনি বললেন, বিচার বা শাসনকার্যে ঘুষ গ্রহণ।”[5]
তাহলে দেখা যায় যে, ঘুষের অর্থে যে নিজে পানাহার করে এবং তার পোষ্যদের পানাহার করায় সকলের জন্যই তা খুবই মন্দ কাজ। এই ঘুষ-লালিত দেহের ইবাদত আল্লাহ কবুল তো করবেনই না বরং তাদের জন্য লাঞ্ছনা, আখিরাতের আগুণ অপেক্ষা করছে।
ইয়াহূদীদের দুর্গতির কারণ হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ سَمَّٰعُونَ لِلۡكَذِبِ أَكَّٰلُونَ لِلسُّحۡتِ ﴾ [المائدة: ٤٢]
“তারা মিথ্যা শ্রবণে অত্যন্ত আগ্রহশীল এবং অবৈধ (ঘুষ) ভক্ষণে অত্যন্ত আসক্ত।” (আল-কুরআন, ৫:৪২)
অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَتَرَىٰ كَثِيرٗا مِّنۡهُمۡ يُسَٰرِعُونَ فِي ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِ وَأَكۡلِهِمُ ٱلسُّحۡتَۚ لَبِئۡسَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٦٢ ﴾ [المائدة: ٦٢]
“হে নবী! আপনি (আহলে কিতাবদের) অনেককেই দেখবেন পাপে, সীমালঙ্ঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে (ঘুষ খাওয়াতে) তৎপর। তারা যা করে নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট।” (আল-কুরআন, ৫:৬২)
আয়াতে ‘অবৈধ ভক্ষণ’ তরজমা করা হলেও হাদীসে এই ‘সুহত’ বা অবৈধ আয়কে ঘুষ হিসেবে তাফসীর করে দেওয়া হয়েছে। তবে সকল প্রকার দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত আয়ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
এই ঘুষের বিষয়টি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতে স্পষ্টতই এসেছে। বিচারের রায়কে প্রভাবিত করা এবং প্রশাসকদেরকে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠতা থেকে আলাদা করাই যে ঘুষের মূখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তা প্রতিফলিত হয়েছে এই আয়াতে:
﴿ وَلَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ وَتُدۡلُواْ بِهَآ إِلَى ٱلۡحُكَّامِ لِتَأۡكُلُواْ فَرِيقٗا مِّنۡ أَمۡوَٰلِ ٱلنَّاسِ بِٱلۡإِثۡمِ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ١٨٨ ﴾ [البقرة: ١٨٨]
“তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের বা প্রশাসকদের কাছে পেশ করো না।” (আল-কুরআন, ২: ১৮৮)
এ আয়াতে ‘হুক্কাম’ অর্থ শাসকগণ, প্রশাসনগণ, বিচারকগণ হতে পারে। আরবী ভাষায় হাকিম বা বহুবচনে হুক্কাম শব্দটি এইসব অর্থে সমানভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কথা বুঝানো হয়েছে যাদের সিদ্ধান্তে একজনের সম্পদে অন্য কেউ অন্যায়ভাবে ভাগ বসাতে পারবে। উপর্যুক্ত আয়াতে وتدلوا بها শব্দটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থ হচ্ছে ‘বালতি কুপে ফেলে তা টেনে উঠানো।’ ঠিক তেমনি ঘুষের রশিতে নিজের প্রত্যাশিত বস্তু টেনে আনা হয়। এটি রুপক অর্থে এসেছে।
এজন্যই আল্লামা আলুসী তার তাফসীর রুহুল মা‘আনীতে বলেন: “তোমাদের সম্পদের কিছু অংশ অসাধু বিচারক বা প্রশাসকদেরকে ঘুষ হিসেবে দিও না।”
তাফসীরে মাদারেকেও এ আয়াতের ‘বাতেল’ শব্দ দ্বারা ঘুষ বা রিশওয়াহ বুঝানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[6] এতে প্রমাণিত হলো যে, পবিত্র কুরআনে ঘুষের বিরুদ্ধে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
আজ আমাদের দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকার প্রথম দিকে রয়েছে। এই দুর্নীতির নানা রকমের রয়েছে। তবে ঘুষ হচ্ছে প্রধান ও সবচেয়ে ব্যাপক দুর্নীতি। ঘুষের এই ব্যাপকতা কেবল আখিরাতের জন্যই ভয়াবহ নয়; বরং আমাদের এই সামাজিক জীবনেও দুর্ভোগের কারণ।
ঘুষের বিষয়টি এখন আর লুকোছাপা নেই; তা এখন সবারই জানা। বাসে, লঞ্চে, পথে-ঘাটে মানুষ ঘুষের আলাপ করছে। আমাদের আশপাশের লোকজন তা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। এ রকম অবস্থার কারণেই আমরা জাতি হিসেবে ক্রমশ বোধহীন হয়ে পড়েছি এবং ভবিষ্যতের অজানা লা‘নত অথবা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি অথবা সন্ত্রাসের আরও প্রকোপ দেখে এক বিরাট ভয় আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ধর্মের বাণী আজ আমাদের জীবনে বাস্তব রূপ ধরে আসলেও আল্লাহর হুকুম পালন করার প্রতি আমাদের আগ্রহ নেই, যা দুঃখজনক হলেও সত্য। এ হচ্ছে এক ভয়াবহ অবস্থা।
ঘুষ আমাদের জাতীয় উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। ঘুষের কারণে মানুষ যোগ্যতার মূল্যায়ণ পাচ্ছে না। ঘুষের চিন্তায় যখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাথা ঘুরতে থাকে তখন হাতের কলম সিরাতুল মুস্তাকীমে চলে না। ঘুষ হচ্ছে সমাজদেহে নীরব মরণ ব্যাধি। সকল নীতি-নৈতিকতা, সমস্ত আইন-কানুন, বিধি-বিধানকে বিধ্বস্ত করে দেওয়ার জন্য ঘুষ নামক এই নমরুদই দায়ী। এ হচ্ছে এক মরণ ভাইরাস যা আমাদের সমাজের সকল ব্যবস্থাপনাকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমাদের উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবে না এবং আমরাও একটি সময় অতীতের নমরূদ, ফিরাউনদের ন্যায় অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হব ও আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে যাব। কালব- এর পরিশুদ্ধির জন্য দেহ পরিশুদ্ধ থাকতে হয়। হালাল রুজি বা সৎ উপার্জনকারী আল্লাহর বন্ধু বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন। পক্ষান্তরে অসৎ উপার্জন করে অতি তাড়াতাড়ি সুখের সন্ধান করা আসলে বৃথা। অনেকেই অর্থ উপার্জনে সুবিধাজনক বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করেই তার পেশায় এমনভাবে মগ্ন হয় যেন সে পারে তো দু দিনেই বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে যায়। লোকের সেবা করা এবং এজন্য ত্যাগী মনোভাব নিয়ে কাজ করার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে এই তাড়াহুড়া করে অসৎভাবে উপার্জন করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন:
«إن نفسا لا تموت حتى تستكمل رزقها فاتقوا الله وأجملوا في الطلب، ولا يحملنكم استبطاء الرزق أن تطلبوه بمعاصي الله، فإن الله لا يدرك ما عنده إلا بطاعته».
“কোনো প্রাণী তার রিযিক পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কখনও মরবে না। সাবধান! আল্লাহকে ভয় করো এবং আবেদনে সৌন্দর্য বজায় রাখো। তোমার রিযিক ধীরগতিতে আসার কারণে তা আল্লাহর নাফরমানির মাধ্যমে চেয়ো না। কারণ তাঁর নিকট যা আছে তা লাভ করতে হলে তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমেই করতে হবে।” (বাযযার, ইবন মাসউদ রা. হতে)
তবে কেউ যদি অন্যের সম্পদ গ্রাস করে তবে তার পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ فَبِظُلۡمٖ مِّنَ ٱلَّذِينَ هَادُواْ حَرَّمۡنَا عَلَيۡهِمۡ طَيِّبَٰتٍ أُحِلَّتۡ لَهُمۡ وَبِصَدِّهِمۡ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ كَثِيرٗا ١٦٠ وَأَخۡذِهِمُ ٱلرِّبَوٰاْ وَقَدۡ نُهُواْ عَنۡهُ وَأَكۡلِهِمۡ أَمۡوَٰلَ ٱلنَّاسِ بِٱلۡبَٰطِلِۚ وَأَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ مِنۡهُمۡ عَذَابًا أَلِيمٗا ١٦١ ﴾ [النساء: ١٥٩، ١٦١]
“যারা ইয়াহূদী ছিল, তাদের যুলুমের কারণে আমরা তাদের ওপর এমন সব পবিত্র বস্তু হারাম করে দিয়েছি, যা ছিল তাদের জন্য হালাল। এছাড়াও আল্লাহর পথে অনেক বাধা দেওয়ার জন্য তা করেছিলাম এবং তারা সুদ গ্রহণের কারণে- যা তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল এবং অন্যায়ভাবে লোকের ধনসম্পদ গ্রাস করার জন্য। কাফিরদের মর্মন্তুদ শান্তি প্রস্তুত রেখেছি।” (আল-কুরআন, ৪:১৬০-১৬১)
এমনিভাবে অসৎ উপার্জন করে গাড়ি-বাড়ি, বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভ করার যে তীব্র আকাঙ্খা মানুষের মনে জাগে এবং শয়তান এইসব অপকর্মকে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করে সামনে তুলে ধরে, এর পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ!
ইসলামে ঘুষ সম্পূর্ণরূপে হারাম। ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহিতা উভয়ে জাহান্নামী।
তাই আসুন, আমরা তওবা করে ঘুষকে পরিত্যাগ করি, এর বিরুদ্ধাচরণ করি। একে ঘৃণা করি, একে প্রতিরোধ করি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন। আমীন।
বাঁচার উপায়:
রোগের চিকিৎসার চেয়ে তার প্রতিরোধই হচ্ছে উত্তম ব্যবস্থা। এ জন্য ঘুষ লেনদেন সংঘটনের পূর্বেই তার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, শিক্ষা -প্রশিক্ষণ ও বাস্তব ভিত্তিক সর্মসূচীর মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করার পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়াও নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
ক. আখিরাতের চেতনা জাগ্রতকরণ:
দুনিয়ার জীবনই মানুষের শেষ নয় বরং মৃত্যুর পর মানুষকে আখিরাতের অনন্ত জীবনে প্রবেশ করতে হবে। সেদিন আল্লাহ তা‘আলার দরবারে দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে। মূলত আখিরাতের চেতনা মানুষের জীবনে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে থাকে। যে ব্যক্তি আখিরাতে সত্যিকার বিশ্বাস করে সে কখনও ঘুষ গ্রহন করতে পারে না। মানুষের দুনিয়ার জীবন হচ্ছে অতি সংক্ষিপ্ত এবং আখিরাতই হচ্ছে অনন্ত জীবন। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে:
﴿ بَلۡ تُؤۡثِرُونَ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا ١٦ وَٱلۡأٓخِرَةُ خَيۡرٞ وَأَبۡقَىٰٓ ١٨ ﴾ [الاعلا: ١٦، ١٨]
“বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে বেশী প্রধান্য দিচ্ছ। অথচ আখিরাত সর্বোত্তম এবং চিরস্থায়ী” (সূরা আল আ‘লা: ১৬-১৭ )
এ চেতনা যখন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হবে, তখন সে অবশ্যই এ থেকে বিরত থাকবে।
খ.হালাল হারামের দিক-নির্দেশনা দান:
অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে জনগণকে হালাল-হারামের দিক নির্দেশনামূলক শিক্ষা প্রদান করা উচিত। কেননা ইসলাম হালাল বা বৈধ বিষয় উপার্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে এবং হারাম উপার্জন বর্জন করার নির্দেশ দিয়েছে, এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَكُلُواْ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ حَلَٰلٗا طَيِّبٗا وَٱشۡكُرُواْ نِعۡمَتَ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ ١١٤﴾ [النحل:114]
“আল্লাহ তোমাদের হালাল এবং পবিত্র যা দিয়েছেন তা হতে তোমরা আহার কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা কেবল তারই ইবাদত কর।” (সূরা আন নাহল: ১১৪)
রাজনৈতিক ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ অনেক সময় অর্থ আত্মসাৎ করে থাকেন। অবৈধভাবে যে কোনো প্রকার অর্থ আত্মসাৎকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে।
গ. দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি মুক্ত হওয়া:
চাকুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি সততা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রদান করা জরুরী। কারণ এ সমস্ত চাকুরি প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের নিকট আমানত। ইসলাম এ সমস্ত আমানত তার যোগ্য প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا ٥٨ ﴾ [النساء: ٥٨]
“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানত তার যথার্থ মালিককে প্রত্যার্পণ কর।” (সূরা আন-নিসা: ৫৮)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ
“তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নেতা তার অধীনস্থদের জন্য জবাবদিহী করবেন।”[7]
ঘ. উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদানঃ
প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প বেতনের কারণে মানুষ ঘুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এজন্য ইসলাম প্রত্যেককে এমন মজুরি বা বেতন প্রদানের কথা বলেছে যে তা দ্বারা সে তার ন্যায়ানুগ ও স্বাভাবিক প্রয়োজন মেটাতে পারে। শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ إِخْوَانَكُمْ خَوَلُكُمْ جَعَلَهُمُ اللَّهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ، فَمَنْ كَانَ أَخُوهُ تَحْتَ يَدِهِ، فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ، وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ، وَلاَ تُكَلِّفُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ، فَإِنْ كَلَّفْتُمُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ فَأَعِينُوهُمْ»
“তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। কারো ভাই তার অধীনে থাকলে তার উচিত নিজে যা খাবে তাই খাওয়াবে। নিজে যা পরবে তাকেও তা পরতে দিবে এবং তাকে দিয়ে এমন কাজ করাবে না যা তার সাধ্যাতীত। কোনভাবে তার উপর আরোপিত বোঝা বেশি হয়ে গেলে নিজেও সে কাজে তাকে সাহায্য করবে।”[8]
ঙ. যোগ্য, অভিজ্ঞ ও সৎ কর্মচারি নিয়োগ দান:
প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও অসৎ কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে এসব কর্মকর্তা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েই তার বিনিয়োগকৃত সমুদয় অর্থ উত্তোলনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অতএব প্রশাসনকে ঘুষের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য সৎ, বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন,
﴿ إِنَّ خَيۡرَ مَنِ ٱسۡتَٔۡجَرۡتَ ٱلۡقَوِيُّ ٱلۡأَمِينُ ٢٦ ﴾ [القصص: ٢٦]
“তোমার জন্য সর্বোত্তম কর্মচারী হতে পারে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত। (সূরা আল কাসাস: ২৬)
﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا﴾ [آل عمران: 58]
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানত তার মালিককে প্রত্যার্পণ কর।” (সূরা আন নিসা: ৫৮)
এভাবে ইসলাম সৎ, যোগ্য ও বিশ্বস্ত কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটনের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিতে চায়।
চ. গণসচেতনতা সৃষ্টি:
ঘুষ গ্রহণ এক ধরণের দুর্নীতি। এ দুর্নীতির ভয়াবহতা এবং এর নেতিবাচক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে সকল স্তরের মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। যাতে সমাজের প্রতিটি মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। বিষয়টি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কেননা এদেশের জনগণ ধর্মভীরু এবং সরল প্রকৃতির। তাদেরকে যদি ঘুষের ক্ষতিকর প্রভাব এবং তার ইহকালীন ও পরকালীন পরিণতির বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তা খুব সহজে প্রতিরোধ সম্ভব। দেশের সকল প্রচার মাধ্যম জনমত ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য রেডিও, টেলিভিশনসহ পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যদি জনগণকে এর কুফল ও ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করা যায়, তাহলে তা ঘুষ প্রতিরোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ছ. প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ:
শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের জন্য জবাবদিহিতার কোনো বিকল্প নেই। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত জবাবদিহিতার নিশ্চিতকরণ অফিস আদালতে ঘুষের লেনদেন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকে স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”[9]
জ. ঘুষগ্রহীতাদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানঃ
সমাজ থেকে ঘুষ-বাণিজ্য চিরতরে উচ্ছেদ করতে হলে শুধুমাত্র উপদেশ, সতর্কবাণী ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা করেই তার দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না বরং কোনো ব্যক্তি যদি এ কাজে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করবে, যেন মানুষ শাস্তির পরিণতির ভয়ে ঘুষের লেনদেন থেকে দূরে থাকে।
ঝ.মানুষের অধিকার আদায়ের ব্যপারে সচেষ্ট হওয়া:
ঘুষের মাধ্যমে যে সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হয় তার অধিকাংশই মানুষের অধিকার বিষয়ক। যেমন, যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদান, প্রমোশন প্রদান, সুযোগ-সুবিধা, স্বজনপ্রীতি ও অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ ইত্যাদি। অধিকারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ক্ষমা না করলে আল্লাহও ক্ষমা করবেন না।
ঞ. সম্পদ অর্জনে ইসলামী নীতি অবলম্বন:
সম্পদের মোহ এবং উচ্চাভিলাষী জীবন-যাপনই ঘুষের লেনদেনের অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষ মৃত্যুর কথা এবং আখিরাতকে ভুলে এসবে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এজন্য আল-কুরআনে বারবার মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।” (সূরা আলে ইমরান: ১৮৫ )
তাছাড়া হাদীসে এসেছে,
«ازْهَدْ فِي الدُّنْيَا يُحِبَّكَ اللَّهُ، وَازْهَدْ فِيمَا فِي أَيْدِي النَّاسِ يُحِبُّكَ النَّاسُ»
“পার্থিব ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর লোকের কাছে যা আছে তার লালসা পরিত্যাগ কর। তাহলে অন্যরা তোমাকে ভালবাসবেন।”[10]
তাই অর্থ উপার্জনে হালাল-হারামের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
ট. মানব মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া:
মানুষ দ্রুত বিত্তের অধিকারী হওয়ার জন্য সাধারণত ঘুষ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিত্তশালীর চেয়ে বিত্তহীনের বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে মর্যাদার মাপকাঠি অর্থবিত্ত নয় বরং ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে যে যতবেশী তাকওয়াসম্পন্ন বা আল্লাহভীরু, সে ততবেশী মর্যাদাবান। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
﴿إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ﴾ [الحجرات: ١٣]
নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত যে অধিক আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনকারী।” ( সূরা আল-হুজুরাত:১৩)
বর্তমানে ঘুষ বাণিজ্য এ দেশকে ধ্বংস ও অধঃপতনের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করছে। অথচ সরকার নির্বিকার। আগামী দিনের সুস্থ-সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় এটি অবশ্যই পরিত্যজ্য। এটি যত আলোচিত হবে জনগণ এ বিষয়ে তত সচেতন হবে এবং তার সুফল ভোগে সমর্থ হবে। এ প্রবন্ধে উল্লেখিত পদক্ষেপসমূহ যদি সমাজে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সমাজ থেকে ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সরকারের উচিত দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকরী ও অর্থবহ করার মাধ্যমে ঘুষ-বাণিজ্য প্রতিরোধে এগিয়ে আসা।
[1] হাদীসটি ইবন মাজাহ সংকলন করেছেন, হাদীস নং ২৩১৩।
[2] আবু দাউদ, সুলাইমান ইবন আশআশ, আস-সুনান, ৩য় খন্ড (সিরিয়া, হিমস: দারুল হাদীস, তা.বি), পৃ. ৩৫৩, হাদীস নং-২৯৪৩।
[3] সুবুলুস সালাম, খ. ৪, পৃ. ১২৪।
[4] আহমদ ইবন হাম্বল, আল-মুসনাদ, ২য় খন্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮৭।
[5] কানযুল উম্মাল, খ. ৩।
[6] খ. ১, পৃ. ৭৬।
[7] ইমাম বুখারী, সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড, বাবুল জুম‘আ ফিল ক্বুরা ওয়াল মুদুন, পৃ. ৫, হাদীস নং- ৮৯৩।
[8] বুখারী, হাদীস নং ২৫৪৫।
[9] ইমাম বুখারী, সহীহুল বুখারী, ২য় খন্ড, বাবুল জুম‘আ ফিল ক্বুরা ওয়াল মুদুন, পৃ. ৫, হাদীস নং- ৮৯৩।
[10] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৪১০২।
_________________________________________________
লেখক: মো. আব্দুল কাদের
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

গুরুতর অপরাধ মানুষ হত্যা

🔘🔘🔘 গুরুতর অপরাধ মানুষ হত্যা 🔘🔘🔘
অশান্তির আগুনে ঘেরা পৃথিবী। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ভরা অবনী। এ পৃথিবীতে এখন মানবজীবনের চেয়ে সস্তা কিছু নেই। বিশেষত বাংলাদেশের মতো তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলোয় মাত্র ১০ টাকার জন্যও মানুষ খুন হচ্ছে। মিডিয়ায় কান পাতলে কিংবা সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলেই নিহতের স্বজনের আহাজারী আর মাতমের দৃশ্য থাকবেই। সন্তানের হাতে জন্মদাতা কিংবা জন্মদাতার হাতে সন্তান, স্বামীর হাতে স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর হাতে স্বামী, শিক্ষকের হাতে ছাত্র কিংবা ছাত্রের হাতে শিক্ষক, কর্মচারীর হাতে মালিক কিংবা মালিকের হাতে কর্মচারী, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সাধারণ নাগরিক কিংবা নাগরিকের হাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য খুন- কোনোটাই যেন এখন আর অস্বাভাবিক নয়!
এদিকে কথিত উন্নত ও সভ্য দেশগুলো মোড়লিপনা দেখাতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন চালিয়ে খুন করছে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে। যারা মুসলিম দেশগুলোকে মানবাধিকারের সবক দেয়, তারাই আবার মজলুম মুসলিম দেশগুলোয় প্রতিদিন নিষ্পাপ শিশু ও অসহায় নারী ও বৃদ্ধদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করছে। পৃথিবীর মানচিত্রজুড়েই এখন মুসলিমের তপ্ত খুনের ছোপছোপ দাগ।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে যোগ হয়েছে গুম নামের এক আতঙ্ক। সুস্থ-সবল মানুষকে চোখের সামনে পরিবার থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে আর সে লোকটি ঘরে ফিরছে লাশ হয়ে। কখনো এ লাশটিও আর ফেরত পাচ্ছে না হতভাগা পরিবার। কে নিচ্ছে, কোথায় নিচ্ছে, কারা নিচ্ছে- কোনোটারই যেন হদিস নেই।
পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মতো বাংলাদেশের নাগরিকরাও এ হত্যা-নৈরাজ্য থেকে পরিত্রাণ খুঁজে ফিরছে। মুক্তির অন্বেষায় তারাও যত্রতত্র ধর্ণা দিচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। লাশের মিছিল কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হচ্ছে। এমতাবস্থায় আর সব সমস্যার মতো এর সমাধানেও ইসলামই হতে পারে হতাশায় আলোকদিশা। উপায়হীনের অব্যর্থ উপায়। সেটি হলো, আমাদেরকে অবশ্যই ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তুলে ধরতে হবে ইসলামের অমলধবল আলোকশিখা।
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহের অমূল্য বাণীগুলো মানব হত্যাকে হারাম ঘোষণা করেছে। অন্যায়ভাবে অপরের প্রাণ হরণকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বড় গুনাহসমূহের। শুধু তাই নয় পৃথিবীতে যত রকমের গুনাহের কাজ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মহান আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার বা শরীক সাব্যস্ত করা। এরপর সবচেয়ে বড় গুনাহ অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা। হন্তারকের জন্য মহান আল্লাহ দুনিয়ায় বড় শাস্তি এবং আখেরাতে তীব্র আযাবের ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ۞قُلۡ تَعَالَوۡاْ أَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمۡ عَلَيۡكُمۡۖ أَلَّا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗاۖ وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَوۡلَٰدَكُم مِّنۡ إِمۡلَٰقٖ نَّحۡنُ نَرۡزُقُكُمۡ وَإِيَّاهُمۡۖ وَلَا تَقۡرَبُواْ ٱلۡفَوَٰحِشَ مَا ظَهَرَ مِنۡهَا وَمَا بَطَنَۖ وَلَا تَقۡتُلُواْ ٱلنَّفۡسَ ٱلَّتِي حَرَّمَ ٱللَّهُ إِلَّا بِٱلۡحَقِّۚ ذَٰلِكُمۡ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ١٥١ ﴾ [الانعام: ١٥١]
‘বল, “এসো, তোমাদের ওপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা তিলাওয়াত করি যে, তোমরা তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি ইহসান করবে আর দারিদ্র্যের কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। আমিই তোমাদেরকে রিয্ক দেই এবং তাদেরকেও। আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না- তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন। এগুলো আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা বুঝতে পার।”’ {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ১৫১}
তাফসীরকার বাগবী (রহ.) বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ যে কোনো মুমিন ও মুসলিম রাষ্ট্রে ট্যাক্স প্রদানকারী অমুসলিম নাগরিককে অন্যায়ভাবে হত্যা হারাম ঘোষণা করেছেন। হত্যার ন্যায়সঙ্গত কারণের মধ্যে রয়েছে ইরতিদাদ তথা কোনো মুসলিমের ইসলাম ধর্মত্যাগ, কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা এবং রজম তথা বিবাহিত ব্যক্তির জেনা-ব্যভিচারের দণ্ড। [মা‘আলিমুত তানযীল : ৩/২০৩]
আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَٱلَّذِينَ لَا يَدۡعُونَ مَعَ ٱللَّهِ إِلَٰهًا ءَاخَرَ وَلَا يَقۡتُلُونَ ٱلنَّفۡسَ ٱلَّتِي حَرَّمَ ٱللَّهُ إِلَّا بِٱلۡحَقِّ وَلَا يَزۡنُونَۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ يَلۡقَ أَثَامٗا ٦٨ يُضَٰعَفۡ لَهُ ٱلۡعَذَابُ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَيَخۡلُدۡ فِيهِۦ مُهَانًا ٦٩ ﴾ [الفرقان: ٦٧، ٦٨]
‘আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে না এবং যারা আল্লাহ যে নাফ্সকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর যারা ব্যভিচার করে না। আর যে তা করবে সে আযাবপ্রাপ্ত হবে। কিয়ামতের দিন তার আযাব বর্ধিত করা হবে এবং সেখানে সে অপমানিত অবস্থায় স্থায়ী হবে।’ {সূরা আল-ফুরকান, আয়াত : ৬৮-৬৯}
কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে ইসলাম তার প্রতিকারের কার্যকর ব্যবস্থা নির্দেশ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَلَا تَقۡتُلُواْ ٱلنَّفۡسَ ٱلَّتِي حَرَّمَ ٱللَّهُ إِلَّا بِٱلۡحَقِّۗ وَمَن قُتِلَ مَظۡلُومٗا فَقَدۡ جَعَلۡنَا لِوَلِيِّهِۦ سُلۡطَٰنٗا فَلَا يُسۡرِف فِّي ٱلۡقَتۡلِۖ إِنَّهُۥ كَانَ مَنصُورٗا ٣٣ ﴾ [الاسراء: ٣٣]
‘আর তোমরা সেই নাফসকে হত্যা করো না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন, সঙ্গত কারণ ছাড়া। যে অন্যায়ভাবে নিহত হয় আমি অবশ্যই তার অভিভাবককে ক্ষমতা দিয়েছি। সুতরাং হত্যার ব্যাপারে সে সীমালঙ্ঘন করবে না; নিশ্চয় সে হবে সাহায্যপ্রাপ্ত। {সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত : ৩৩}
এ আয়াতে কিসাস তথা হত্যার বদলা হিসেবে হত্যার বিধানের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অন্য সূরায় যেটি পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা যেমন বলেন,
﴿ وَكَتَبۡنَا عَلَيۡهِمۡ فِيهَآ أَنَّ ٱلنَّفۡسَ بِٱلنَّفۡسِ وَٱلۡعَيۡنَ بِٱلۡعَيۡنِ وَٱلۡأَنفَ بِٱلۡأَنفِ وَٱلۡأُذُنَ بِٱلۡأُذُنِ وَٱلسِّنَّ بِٱلسِّنِّ وَٱلۡجُرُوحَ قِصَاصٞۚ فَمَن تَصَدَّقَ بِهِۦ فَهُوَ كَفَّارَةٞ لَّهُۥۚ وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٤٥ ﴾ [المائدة: ٤٥]
‘আর আমি এতে তাদের উপর অবধারিত করেছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান ও দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং জখমের বিনিময়ে সমপরিমাণ জখম। অতঃপর যে তা ক্ষমা করে দেবে, তার জন্য তা কাফ্ফারা হবে। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করবে না, তারাই যালিম।’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৪৫}
বর্তমান অন্যায় অবিচারে ভরা জগতের অনেক মানুষ ইসলামের এ বিধানটিকে অমানবিক আবার কোনো কোনো অবিশ্বাসী একে বর্বর পর্যন্তও বলে বসেন। অথচ বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবচিত্রও সাক্ষ্য দেয় আপাতদৃষ্টিতে কঠোর মনে হলেও এর মাধ্যমেই মানবজাতির মুক্তি ও শান্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা বুঝি না বলেই যত অমূলক সমালোচনা। কিসাসের আয়াতের শেষাংশে যেমন ‘বিবেকসম্পন্নগণ’ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡقِصَاصُ فِي ٱلۡقَتۡلَىۖ ٱلۡحُرُّ بِٱلۡحُرِّ وَٱلۡعَبۡدُ بِٱلۡعَبۡدِ وَٱلۡأُنثَىٰ بِٱلۡأُنثَىٰۚ فَمَنۡ عُفِيَ لَهُۥ مِنۡ أَخِيهِ شَيۡءٞ فَٱتِّبَاعُۢ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَأَدَآءٌ إِلَيۡهِ بِإِحۡسَٰنٖۗ ذَٰلِكَ تَخۡفِيفٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَرَحۡمَةٞۗ فَمَنِ ٱعۡتَدَىٰ بَعۡدَ ذَٰلِكَ فَلَهُۥ عَذَابٌ أَلِيمٞ ١٧٨ وَلَكُمۡ فِي ٱلۡقِصَاصِ حَيَوٰةٞ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٧٩ ﴾ [البقرة: ١٧٨، ١٧٩]
‘হে মুমিনগণ, নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের উপর ‘কিসাস’ ফরয করা হয়েছে। স্বাধীনের বদলে স্বাধীন, দাসের বদলে দাস, নারীর বদলে নারী। তবে যাকে কিছুটা ক্ষমা করা হবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে, তাহলে সততার অনুসরণ করবে এবং সুন্দরভাবে তাকে আদায় করে দেবে। এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে হালকাকরণ ও রহমত। সুতরাং এরপর যে সীমালঙ্ঘন করবে, তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। আর হে বিবেকসম্পন্নগণ, কিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৭৮-১৭৯}
পৃথিবীতে হত্যার পরিসংখ্যান দেখলে জানা যাবে, সৌদি আরব যেখানে একমাত্র এই কিসাস ব্যবস্থা এখনো বলবৎ রয়েছে, সবচেয়ে কম খুনোখুনির ঘটনা ঘটে। ইসলামকে যারা বর্বর বলে তারা শুধু জ্ঞানপাপীই নয়, মূর্খও বটে। কারণ, ইসলামই পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম যেখানে যে কোনো নিরপরাধ মানুষের প্রাণসংহারকে মানবতাবিরোধী ও মানবজাতির হত্যার তুল্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ مِنۡ أَجۡلِ ذَٰلِكَ كَتَبۡنَا عَلَىٰ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ أَنَّهُۥ مَن قَتَلَ نَفۡسَۢا بِغَيۡرِ نَفۡسٍ أَوۡ فَسَادٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ ٱلنَّاسَ جَمِيعٗا وَمَنۡ أَحۡيَاهَا فَكَأَنَّمَآ أَحۡيَا ٱلنَّاسَ جَمِيعٗاۚ وَلَقَدۡ جَآءَتۡهُمۡ رُسُلُنَا بِٱلۡبَيِّنَٰتِ ثُمَّ إِنَّ كَثِيرٗا مِّنۡهُم بَعۡدَ ذَٰلِكَ فِي ٱلۡأَرۡضِ لَمُسۡرِفُونَ ٣٢ ﴾ [المائدة: ٣٢]
‘এ কারণেই, আমি বনী ইসরাঈলের ওপর এই হুকুম দিলাম যে, যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল। আর অবশ্যই তাদের কাছে আমার রাসূলগণ সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে। তা সত্ত্বেও এরপর জমিনে তাদের অনেকে অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারী।’ {সূরা মায়েদা, আয়াত : ৩২}
তেমনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও হত্যাকাণ্ডকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« أَكْبَرُ الْكَبَائِرِ الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَقَتْلُ النَّفْسِ ، وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ ، وَقَوْلُ الزُّورِ » .
‘কবীরা গুনাহগুলোর মধ্যে সবচে বড় গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।’ (বুখারী : ৬৮৭১; মুসলিম : ৮৮)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« أَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ فِى الدِّمَاءِ » .
‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে প্রথম বিচার করা হবে রক্তপাত সম্পর্কে।’[1] [বুখারী : ৬৩৫৭; মুসলিম : ৩১৭৮]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
« اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ » . قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا هُنَّ قَالَ « الشِّرْكُ بِاللَّهِ ، وَالسِّحْرُ ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِى حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ ، وَأَكْلُ الرِّبَا ، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ ، وَالتَّوَلِّى يَوْمَ الزَّحْفِ ، وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلاَتِ » .
‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাক। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সেগুলো কী হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন,
১. আল্লাহর সাথে শরীক করা
২. জাদু করা
৩. অন্যায়ভাবে নিরপরাধ লোককে হত্যা করা
৪. সুদ খাওয়া
৫. এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা
৬. রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা
৭. সুরক্ষিত পবিত্রা নারীকে অপবাদ দেওয়া।’ [বুখারী : ৬৮৫৬; মুসলিম : ১২৯]
ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
« لَنْ يَزَالَ الْمُؤْمِنُ فِى فُسْحَةٍ مِنْ دِينِهِ ، مَا لَمْ يُصِبْ دَمًا حَرَامًا » .
‘মুমিন তার দীনের ব্যাপারে সর্বদা অবকাশের মধ্যেই থাকে যাবৎ না সে নিষিদ্ধ রক্তপাত ঘটায়।’ [বুখারী : ৬৮৬২]
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
« يَجِىءُ الْمَقْتُولُ بِالْقَاتِلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ نَاصِيَتُهُ وَرَأْسُهُ بِيَدِهِ وَأَوْدَاجُهُ تَشْخُبُ دَمًا يَقُولُ يَا رَبِّ هَذَا قَتَلَنِى حَتَّى يُدْنِيَهُ مِنَ الْعَرْشِ ».
‘কিয়ামতের দিন নিহত ব্যক্তি হন্তারককে নিয়ে আসবে। হন্তারকের চুলের অগ্রভাগ ও মাথা নিহতের হাতের মুষ্ঠিতে থাকবে আর তার কণ্ঠনালী থেকে তখন রক্ত ঝরতে থাকবে। সে বলবে, হে রব, এ ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এমনকি সে তাকে আরশের কাছে নিয়ে যাবে।’ [তিরমিযী : ২৯৫৫; মুসনাদ আহমদ : ২৫৫১, সহীহ, সিলসিলা সহীহা : ২৬৯৭]
আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
يَخْرُجُ عُنُقٌ مِنَ النَّارِ يَتَكَلَّمُ يَقُولُ : وُكِّلْتُ الْيَوْمَ بِثَلاَثَةٍ : بِكُلِّ جَبَّارٍ ، وَبِمَنْ جَعَلَ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ ، وَبِمَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ ، فَيَنْطَوِي عَلَيْهِمْ فَيَقْذِفُهُمْ فِي غَمَرَاتِ جَهَنَّمَ.
‘জাহান্নাম থেকে একটি গলা বের হয়ে কথা বলতে শুরু করবে। সে বলবে, আজ আমি তিন ব্যক্তির প্রতি ন্যস্ত হয়েছি : প্রত্যেক অত্যাচারী, যে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক স্থির করে এবং ওই ব্যক্তি যে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে। অতপর সে তাদের থাবা দিয়ে কব্জা করবে এবং জাহান্নামের গহীনে তাদের নিক্ষেপ করবে।’ [মুসনাদ আহমদ : ১১৩৭২, সহীহ, সিলসিলা সহীহা : ২৬৯৯]
আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
« إِنَّ مِنْ وَرْطَاتِ الأُمُورِ الَّتِى لاَ مَخْرَجَ لِمَنْ أَوْقَعَ نَفْسَهُ فِيهَا ، سَفْكَ الدَّمِ الْحَرَامِ بِغَيْرِ حِلِّهِ » .
‘যেসব পরিত্রাণঅযোগ্য ধ্বংসে মানুষ পতিত হয় তার অন্যতম হলো বৈধ কারণ ছাড়া নিষিদ্ধ রক্ত ঝরানো।’ [বুখারী : ৬৮৬৩]
বলাবাহুল্য, এসব গেল হত্যা ও খুনোখুনির আইনী প্রতিকারের দিক। সত্যিকারার্থে পরিত্রাণ চাইলে আমাদেরকে এর নৈতিক দিকগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। ক্রমবর্ধমান মূল্যবোধের অবক্ষয় ও মানবিক গুণাবলির অধোঃপাতের কথাও চিন্তা করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ظَهَرَ ٱلۡفَسَادُ فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ بِمَا كَسَبَتۡ أَيۡدِي ٱلنَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعۡضَ ٱلَّذِي عَمِلُواْ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٤١ ﴾ [الروم: ٤١]
‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে ফাসাদ প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ {সূরা আর-রূম, আয়াত : ৪১}
সত্যিই তো আজ যেসব সামাজিক ব্যধি ও সমস্যায় আমরা নাকাল, এর দায় তো আমাদেরই। আমাদের ব্যক্তিগত আমল ও আচরণের দিকে তাকালেই সেটা পরিষ্কার দেখা যায়। কিয়ামত যত ঘনিয়ে আসছে অবস্থার যেন ততই অবনতি ঘটছে। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَكْثُرَ الْهَرْجُ قَالُوا وَمَا الْهَرْجُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الْقَتْلُ الْقَتْلُ
‘কিয়ামত ততক্ষণ সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না হারাজ বেশি হবে। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হারাজ’ কী হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন হত্যা, হত্যা।’ [মুসলিম : ৫১৪৩]
হত্যাকাণ্ডের এ রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেতে আমাদের যেমন আল্লাহর আইনের সুফল অনুধাবন জরুরী, আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার জরুরী, তেমনি প্রয়োজন নিজেদের সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও যাবতীয় পাপাচার থেকে একনিষ্ঠভাবে তাওবা করা। নিজেদের সন্তান তথা ভবিষ্যত প্রজন্মকে আল্লাহভীতি ও নৈতিকতার বলে বলীয়ান হিসেবে গড়ে তোলা। সব ধরনের অশ্লীলতা ও বেহায়পনা থেকে তাদেরকে যে কোনো মূল্যে দূরে রাখা। বলিউড হলিউডের সিনেমা আর স্যাটেলাইট কালচার আমাদের সন্তানদের মানবিক বিকাশকে শুধু বাধাগ্রস্তই করছে না, তাদেরকে হিংস্র ও নরপশু বানিয়ে ছাড়ছে। পার্থিব ভোগ লালসা মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে ছাড়ছে। আল্লাহ আমাদের অনুধাবন ও সংশোধনের তাওফীক দান করুন। আমীন।
[1]. ইমাম নববী (রহ.) বলেন, এ হাদীসে রক্তপাতের অপরাধের গুরুতরতা তুলে ধরা হয়েছে। আর তা হলো কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে যত বিষয়ে বিচারাচার হবে রক্তপাত তার মধ্যে প্রথম। এ হাদীসটি সুনানগুলোয় বর্ণিত, أَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ الصَّلاَةُ ‘প্রথম যে বিষয়ে বিচার করা হবে তা হলো সালাত’ হাদীসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। [তিরমিযী : ৩৯৯১] কারণ, সালাতের হাদীসের বিষয়টি বান্দা ও আল্লাহর হকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পক্ষান্তরে আলোচ্য হাদীসটি বান্দার হক সংক্রান্ত। [শরহু সহীহ মুসলিম : ১১/১৬৭]
________________________________________________
লেখক: আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলামহাউজ

কোয়ান্টাম মেথড: এক ভয়াবহ শিরকী ফেতনার নাম!

🔘🔘🔘 কোয়ান্টাম মেথড: এক ভয়াবহ শিরকী ফেতনার নাম! 🔘🔘🔘
এই ফেতনা বাংলাদেশের হাজারও মুসলমানকে শিরক্ কুফরী আর বিদ’আত করতে বাধ্য করছে! মেডিটেশনের আড়ালে ভন্ড গুরুজীর রমরমা ব্যবসা!!
“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন বা জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম।” [সূরা আল মায়েদাহ:-৩]
“সত্যতম বাণী আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মাদের আদর্শ, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়। প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত, আর প্রতিটি বিদআতই পথভ্রষ্টতা।” [সহীহ্ মসলিম:- ২/৫৯৩]
“যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুকে দ্বীন হিসাবে তালাশ করবে, তার নিকট থেকে তা কবুল করা হবেনা। আর আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [সূরা আলে ইমরান:-৮৫]
আল্লাহর বানী এত্ত স্পষ্ট হওয়ার পরেও এক জন মুসলমানের জীবনে শান্তি খুজতে কোয়ান্টাম মেথড এর সাহাজ্য নিতে হয় কেন এবং কোন সাহসে!??
কোয়ান্টাম মেথড : একটি শয়তানী ফাঁদ
মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে ফিরিয়ে কথিত অন্তর্গুরুর ইবাদতে লিপ্ত করার অভিনব প্রতারণার নাম হ’ল কোয়ান্টাম মেথড। হাযার বছর পূর্বে ফেলে আসা হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান পাদ্রী ও যোগী-সন্ন্যাসীদের যোগ-সাধনার আধুনিক কলা-কৌশলের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মেডিটেশন’।
হতাশাগ্রস্ত মানুষকে সাময়িক প্রশান্তির সাগরে ভাসিয়ে এক কল্পিত দেহভ্রমণের নাম দেওয়া হয়েছে Science of Living বা জীবন-যাপনের বিজ্ঞান। আকর্ষণীয় কথার ফুলঝুরিতে ভুলে টাকাওয়ালা সাধারণ শিক্ষিত মানুষেরা এদের প্রতারণার ফাঁদে নিজেদেরকে সঁপে দিচ্ছেন অবলীলাক্রমে। ব্যয় করছেন কথিত ধ্যানের পিছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঢেলে দিচ্ছেন হাযার হাযার টাকা। অথচ একটা রঙিন স্বপ্ন ছাড়া তাদের ভাগ্যে কিছুই জুটছে না। অন্যদিকে মুসলমান যারা এদের দলে ভিড়ছে, তারা শিরকের মহাপাতকে লিপ্ত হয়ে দুনিয়া ও আখেরাত দু’টিই হারাচ্ছে। নিম্নে আমরা এদের আক্বীদা-বিশ্বাস ও কর্মনীতি যাচাই করব।- কোয়ান্টামের পঞ্চসূত্র হ’ল, প্রশান্তি, সুস্বাস্থ্য, প্রাচুর্য, সুখী পরিবার ও ধ্যান। বলা হয়েছে, কোয়ান্টাম প্রত্যেকের ধর্মবিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করে। সুখী মানুষের সবটুকু প্রয়োজন পূরণের প্রক্রিয়াই রয়েছে কোয়ান্টামে। তাই কোয়ান্টামই হচ্ছে নতুন সহস্রাব্দে আধুনিক মানুষের জীবন যাপনের বিজ্ঞান’।
অন্যান্য ডিগ্রীর ন্যায় এখানকার ধ্যান সাধনায় যারা উত্তীর্ণ হয়, তাদেরকে ‘কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট’ বলে শ্রুতিমধুর একটা ডিগ্রী দেওয়া হয়। তাদের প্রচার অনুযায়ী বাংলাদেশে ফলিত মনোবিজ্ঞানের পথিকৃৎ এবং আত্মউন্নয়নে ধ্যান পদ্ধতির প্রবর্তক প্রফেসর এম.ইউ. আহমাদ নাকি ক্লিনিক্যালি ডেড হওয়ার পরেও পুনরায় জীবন লাভ করেন শুধু ‘তাঁকে বাঁচতে হবে, তিনি ছাড়া দেশে নির্ভরযোগ্য মনোচিকিৎসক নেই’ তাঁর এই দৃঢ় বিশ্বাসের জোরে’ (মহাজাতক, কোয়ান্টাম টেক্সট বুক, জানু. ২০০০, পৃঃ ২২-২৪)।
অর্থাৎ হায়াত-মউতের মালিক তিনি নিজেই।
প্রথমে বলে রাখি, মানবরচিত প্রত্যেক ধর্মেই স্ব স্ব নিয়মে ধ্যান পদ্ধতি আছে। হিন্দু-বৌদ্ধ যোগী-সন্ন্যাসীদের সাধন-ভজন সম্বন্ধে আমরা কিছুটা জানি। আল্লাহ প্রেরিত ঈসায়ী ধর্মে সর্বপ্রথম সন্ন্যাসবাদের উদ্ভব হয়। যে বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
‘আর সন্ন্যাসবাদ, সেটাতো তারা নিজেরাই প্রবর্তন করেছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। আমরা তাদেরকে এ বিধান দেই নি। অথচ এটাও তারা যথাযথভাবে পালন করে নি। তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিল, তাদেরকে আমরা পুরস্কার দিয়েছিলাম। আর তাদের অধিকাংশ ছিল পাপাচারী’ (হাদীদ ৫৭/২৭)।
এখানে আল্লাহ তাদেরকে দুইভাবে নিন্দা করেছেন।
১. তারা আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত অর্থাৎ নতুন রীতির উদ্ভাবন করেছিল।
২. তারা নিজেরা যেটাকে আল্লাহর নৈকট্য মনে করে আবিষ্কার করেছিল, সেটার উপরেও তারা টিকে থাকতে পারেনি। ইসলামের স্বর্ণযুগের পরে ভ্রষ্টতার যুগে মা‘রেফতের নামে বিদ‘আতী পীর-ফকীররা নানাবিধ ধ্যান পদ্ধতি আবিষ্কার করে। অতঃপর কথিত ইশক্বের উচ্চ মার্গে পৌঁছে হুয়া হু করতে করতে যখন চক্ষু ছানাবড়া হয়ে ‘কাশফ’ বা ‘হাল’ হয়, তখন নাকি তাদের আত্মা পরমাত্মার মধ্যে লীন হয়ে যায়। একে তাদের পরিভাষায় ফানা ফিল্লাহ বা বাক্বা বিল্লাহ বলে। এরাই ছূফী ও পীর-মাশায়েখ নামে এদেশে পরিচিত। অথচ এইসব মা‘রেফতী তরীকার কোন অনুমোদন ইসলামে নেই। ধ্যানকে কোয়ান্টামের পরিভাষায় বলা হয় ‘মেডিটেশন’ (Medetation)। যার প্রথম ধাপ হ’ল ‘শিথিলায়ন’ যা মনের মধ্যে ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি করে। আর শেষ ধাপ হ’ল মহা চৈতন্য (Super Consciousness)। যখন তারা বস্ত্তগত সীমা অতিক্রম করে মহা প্রশান্তির মধ্যে লীন হয়ে যায়। যদিও এর কোন সংজ্ঞা তাদের বইতে সুস্পষ্টভাবে নেই। এক্ষণে কোয়ান্টামের সাথে অন্যদের পার্থক্য এই যে, অন্যেরা স্ব স্ব ধর্মের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করেছে ও স্ব স্ব ধর্মের নামেই পরিচিতি পেয়েছে। পক্ষান্তরে কোয়ান্টাম মেথড সকল ধর্ম ও বর্ণের লোকদের নতুন ধ্যানরীতিতে জমা করেছে। খানিকটা সম্রাট আকবরের দ্বীনে এলাহীর মত। তখন আবুল ফযল ও ফৈযীর মত সেকালের সেরা পণ্ডিতবর্গের মাধ্যমে সেটা চালু হয়েছিল মূলতঃ রাজনৈতিক কারণে। আর এ যুগে কিছু উচ্চ শিক্ষিত সুচতুর লোকদের মাধ্যমে এটা চালু হয়েছে ইসলাম থেকে মানুষকে সরিয়ে নেবার জন্যে এবং শিক্ষিত শ্রেণীকে বিশ্বাসে ও কর্মে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ বানাবার জন্যে। যাতে ভবিষ্যতে এদেশ তার ইসলামী পরিচিতি হারিয়ে সেক্যুলার দেশে পরিণত হয়। মুনি-ঋষিরা ধ্যান করে তাদের ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের জন্য। পক্ষান্তরে কোয়ান্টামে ধ্যান করা হয় স্ব স্ব ‘অন্তর্গুরু’কে পাওয়ার জন্য। যেমন বলা হচ্ছে, ‘অন্তর্গুরুকে পাওয়ার আকাংখা যত তীব্র হবে, তত সহজে আপনি তার দর্শন লাভ করবেন। এ ব্যাপারে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েটদের’ (পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪৭)। যেমন একটি ঘটনা বলা হয়েছে, ‘ছেলে কোলকাতায় গিয়েছে। দু’দিন কোন খবর নেই। বাবা কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট। মাগরিবের নামাজ পড়ে মেডিটেশন কমান্ড সেন্টারে গিয়ে ছেলের বর্তমান অবস্থা দেখার চেষ্টা করতেই কোলকাতার একটি সিনেমা হলের গেট ভেসে এল। ছেলে সিনেমা হলের গেটে ঢুকছে। বাবা ছেলেকে তার উদ্বেগের কথা জানালেন। বললেন শিগগীর ফোন করতে’ (পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪১)।এমনিতরো উদ্ভট বহু গল্প তারা প্রচার করেছেন।
• এক্ষণে আমরা দেখব ইসলামের সাথে এর সম্পর্ক:
১. এটি তাওহীদ বিশ্বাসের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং পরিষ্কারভাবে শিরক।
তাওহীদ বিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ কেন্দ্রিক। ইসলামের সকল ইবাদতের লক্ষ্য হ’ল আল্লাহর দাসত্ব ও রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা ও পরকালে মুক্তি লাভ করা। পক্ষান্তরে কোয়ান্টামের ধ্যান সাধনার লক্ষ্য হ’ল অন্তর্গুরুকে পাওয়া। যা আল্লাহ থেকে সরিয়ে মানুষকে তার প্রবৃত্তির দাসত্বে আবদ্ধ করে। এদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ বলেন, ‘আপনি কি দেখেছেন ঐ ব্যক্তিকে, যে তার প্রবৃত্তিকে ইলাহ বানিয়েছে? আপনি কি তার যিম্মাদার হবেন’?
‘আপনি কি ভেবেছেন ওদের অধিকাংশ শুনে বা বুঝে? ওরা তো পশুর মত বা তার চাইতে পথভ্রষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৪৩-৪৪)।
মূলতঃ ঐ অন্তর্গুরুটা হ’ল শয়তান। সে সর্বদা তাকে রঙিন স্বপ্নের মাধ্যমে তার দিকে প্রলুব্ধ করে।
২. তারা বলেন, মনকে প্রশান্ত করার মতো নামাজ যাতে আপনি পড়তে পারেন সেজন্যই মেডিটেশন দরকার।
কেননা নামাজের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হুযুরিল ক্বালব, একাগ্রচিত্ততা। এটা কিভাবে অর্জিত হয়, তা এখানে এলে শেখা যায়’ (প্রশ্নোত্তর ১৪২৭)।
জবাব : এটার জন্য সর্বোত্তম পন্থা হ’ল ছালাত। এর বাইরে কোন কিছুর অনুমোদন ইসলামে নেই।
আল্লাহ বলেন,
তুমি ছালাত কায়েম কর আমাকে স্মরণ করার জন্য’ (ত্বোয়াহা ১৪)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সংকটে পড়তেন তখন ছালাতে রত হ’তেন (আবুদাঊদ হা/১৩১৯)।
তিনি বলেছেন,
তোমরা ছালাত আদায় কর, যেভাবে আমাকে দেখছ’ (বুখারী হা/৬৩১)।
যারা খুশু-খুযুর সাথে ফরয, নফল ও তাহাজ্জুদ ছালাত নিয়মিতভাবে আদায় করে, তাদেরকেই আল্লাহ সফলকাম মুমিন বলেছেন (মুমিনূন ১-২)।
আর ছালাতে ধ্যান করা হয় না। বরং একমনে বান্দা তার সৃষ্টিকর্তার সাথে একান্তে আলাপ করে (বুখারী হা/৫৩১)।
সর্বোচ্চ শক্তির কাছে নিজের দুর্বলতা ও নিজের কামনা-বাসনা পেশ করে সে হৃদয়ে সর্বোচ্চ প্রশান্তি লাভ করে এবং নিশ্চিত আশাবাদী হয়। অথচ মেডিটেশনের কথিত অন্তর্গুরুর কোন ক্ষমতা নেই। তার সাধনায় নিশ্চিত আশাবাদের কোন প্রশ্নই ওঠে না। কেননা ওটা তো স্রেফ কল্পনা মাত্র। ছালাতে আল্লাহর ইবাদত করা হয়। পক্ষান্তরে মেডিটেশনে অন্তর্গুরুর ইবাদত করা হয়। একটি তাওহীদ, অপরটি শিরক। দু’টিকে এক বলা দিন ও রাতকে এক বলার সমান। যা চরম ধৃষ্টতার নামান্তর।
৩. তারা বলেন, কোয়ান্টাম মেডিটেশনের জন্য ধর্ম বিশ্বাস কোন যরূরী বিষয় নয়। ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের সাথে এর কোন বিরোধ নেই।
তাদের কার্যাবলীতে এর প্রমাণ রয়েছে। যেমন, ‘এখন কোয়ান্টাম শিশু কাননে রয়েছে ১৫টি জাতিগোষ্ঠীর চার শতাধিক শিশু। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রামা, খ্রিষ্টান, প্রকৃতিপূজারী সকল ধর্মের শিশুরাই যার যার ধর্ম পালন করছে। আর এক সাথে গড়ে উঠছে আলোকিত মানুষ হিসাবে’ (শিশু কানন)।
জবাব : মানুষকে সকল ধর্ম থেকে বের করে এনে কোয়ান্টামের নতুন ধর্মে দীক্ষা নেবার ও কোয়ান্টাম নেতাদের গোলাম বানানোর চমৎকার যুক্তি এগুলি।
কেননা অন্তর্গুরুর ব্যাখ্যায় তারা বলেছেন, আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর হতে গেলে একজন আলোকিত গুরুর কাছে বায়াত বা দীক্ষা নেয়া প্রয়োজন। এছাড়া আধ্যাত্মিকতার সাধনা এক পিচ্ছিল পথ। যেকোন সময়ই পা পিছলে পাহাড় থেকে একেবারে গিরিখাদে পড়ে যেতে পারেন’ (টেক্সটবুক, পৃঃ ২৪৭)। অর্থাৎ এরা ‘আলোকিত মানুষ’ বানাচ্ছে না। বরং ইসলামের আলো থেকে বের করে এক অজানা অন্ধকারে বন্দী করছে। যার পরিণাম জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা আল্লাহ বলেন,
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করবে, তা কবুল করা হবে না। ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৮৫)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,
আমি তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে এসেছি’ (আহমাদ, মিশকাত হা/১৭৭)।
অতএব ইসলামের প্রকৃত অনুসারীরাই কেবল আলোকিত মানুষ। বাকী সবাই অন্ধকারের অধিবাসী।
৪. তারা বলেন, বহু আলেম আমাদের মেডিটেশন কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং তারা এর সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই বলেছেন।
জবাব : অল্প জ্ঞানী অথবা কপট বিশ্বাসী ও দুনিয়াপূজারী লোকেরাই চিরকাল ইসলামের ক্ষতি করেছে। আজও করছে।
ওমর (রাঃ) বলেন, ইসলামকে ধ্বংস করে তিনটি বস্ত্ত :
(১) আলেমদের পদস্খলন
(২) আল্লাহর কিতাবে মুনাফিকদের ঝগড়া এবং
(৩) পথভ্রষ্ট নেতাদের শাসন’ (দারেমী)।
মনে রাখা আবশ্যক যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। অতএব যা তাঁর ও তাঁর ছাহাবীগণের আমলে দ্বীন হিসাবে গৃহীত ছিল, কেবলমাত্র সেটাই দ্বীন হিসাবে গৃহীত হবে। তার বাইরে কোন কিছুই দ্বীন নয়।
৫. মেডিটেশন পদ্ধতি নিজের উপরে তাওয়াক্কুল করতে বলে এবং শিখানো হয় যে, ‘তুমি চাইলেই সব করতে পার’। এরা হাতে মূল্যবান ‘কোয়ান্টাম বালা’ পরে ও তার উপরে ভরসা করে।
জবাব : ইসলাম মানুষকে মহাশক্তিধর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে শিখায় এবং আল্লাহ যা চান তাই হয়।
এর মাধ্যমে মুমিন নিশ্চিন্ত জীবন লাভ করে ও পূর্ণ আত্মশক্তি ফিরে পায়। আর ইসলামে এ ধরনের
‘বালা’ পরা ও তাবীয ঝুলানো শিরক (ছহীহাহ হা/৪৯২)।
৬. তারা বলেন, শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে এমন এক ক্ষমতা তৈরী হয়, যার দ্বারা সে নিজেই নিজের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারে।
এজন্য একটা গল্প বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক ইঞ্জিনিয়ার সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করার মনছবি দেখতে লাগল। ফলে সে ডিভি ভিসা পেয়ে গেল। তারপর সেখানে ভাল একটা চাকুরীর জন্য মনছবি দেখতে লাগল। ফলে সেখানে যাওয়ার দেড় মাসের মধ্যেই উন্নতমানের একটা চাকুরী পেয়ে গেল’(টেক্সট বুক পৃঃ ১১৫)।
জবাব : ইসলাম মানুষকে তাকদীরে বিশ্বাস রেখে বৈধভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে বলে।
অথচ কোয়ান্টাম সেখানে আল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে কথিত মনছবির পূজা করতে বলে।
৭. কোয়ান্টামের মতে রোগের মূল কারণ হ’ল মানসিক।
তাই সেখানে মনছবি বা ইমেজ থেরাপি ছাড়াও ‘দেহের ভিতরে ভ্রমণ’ নামক পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরের নানা অঙ্গের মধ্য দিয়ে কাল্পনিক ভ্রমণ করতে বলা হয়। এতে সে তার সমস্যার স্বরূপ সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে এবং নিজেই কম্যান্ড সেন্টারের মাধ্যমে সমাধান করতে পারে। যেমন, একজন ক্যান্সার রোগী তার ক্যান্সারের কোষগুলিকে সরিষার দানা রূপে কল্পনা করে। আর দেখে যে অসংখ্য ছোট ছোট পাখি ঐ সরিষাদানাগুলো খেয়ে নিচ্ছে। এভাবে আস্তে আস্তে সর্ষে দানাও শেষ, তার ক্যান্সারও শেষ’ (টেক্সট বুক পৃঃ ১৯৪)।
৮. এদের শোষণের একটি হাতিয়ার হ’ল ‘মাটির ব্যাংক’।
যে নিয়তে এখানে টাকা রাখবেন, সে নিয়ত পূরণ হবে। প্রথমবারে পূরণ না হ’লে বুঝতে হবে মাটির ব্যাংক এখনো সন্তুষ্ট হয়নি। এভাবে টাকা ফেলতেই থাকবেন। কোন মানত করলে মাটির ব্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। পূরণ না হলে অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এখানে খাঁটি সোনার চেইন বা হীরার আংটি দিতে পারেন। ইমিটেশন দিলে মানত পূরণ হবে না (প্রশ্নোত্তর)। এর জন্য একটা গল্প ফাঁদা হয়েছে। যেমন, ‘মধ্যরাতে উঠে মাটির ব্যাংকে পাঁচশত টাকা রাখার সাথে সাথে মুমূর্ষু ছেলে সুস্থ হয়ে গেল’ (দুঃসময়ের বন্ধু..)।
প্রিয় পাঠক! বুঝতে পারছেন, কত সুচতুরভাবে মানুষকে আল্লাহ থেকে সরিয়ে নিয়ে তাদের কম্যান্ড সেন্টারে আবদ্ধ করা হচ্ছে এবং সেই সাথে মাটির ব্যাংকে টাকা ও গহনা রাখার ও তা কুড়িয়ে নেবার চমৎকার ফাঁদ পাতা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে রোগ ও তা আরোগ্য দানের মালিক আল্লাহ। আল্লাহর হুকুম আছে বলেই মুমিন ঔষধ খায়। ঔষধ আরোগ্যদাতা নয়। বরং আল্লাহ মূল আরোগ্যদাতা। এই বিশ্বাস তাকে প্রবল মানসিক শক্তিতে শক্তিমান করে তোলে। এজন্য তাকে মেডিটেশন বা কম্যান্ড সেন্টারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মাটির ব্যাংকে টাকা রাখারও দরকার হয় না। বরং গরীবকে ছাদাক্বা দিলে তার গোনাহ মাফ হয় (মিশকাত হা/২৯)।
৯. অন্যান্য বিদ‘আতীদের ন্যায় এরাও কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করেছে মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে দলে ভিড়ানোর জন্য।
যেমন:
(ক) ‘সকল ধর্মই সত্য’ তাদের এই মতবাদের পক্ষে সূরা কাফেরূনের ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়া লিয়া দ্বীন’ শেষ আয়াতটি ব্যবহার করেছে। যেন আবু জাহলের দ্বীনও ঠিক, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দ্বীনও ঠিক। এই অপব্যাখ্যা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকরা ও তাদের পদলেহীরা করে থাকে। কোয়ান্টামের লোকেরাও করছে। অথচ ইসলামের সারকথা একটি বাক্যেই বলা হয়েছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই। একথার মধ্যে সকল ধর্ম ও মতাদর্শকে অস্বীকার করা হয়েছে। কোয়ান্টামের অন্তর্গুরু নামক ইলাহটিকেও বাতিল করা হয়েছে।
(খ) তারা বলেন মেডিটেশন একটি ইবাদাত। যা রাসূল (ছাঃ) হেরা গুহায় করেছেন’। অথচ এটি স্রেফ তোহমত বৈ কিছু নয়। নিঃসঙ্গপ্রিয়তা আর মেডিটেশন এক নয়। তাছাড়া নবী হওয়ার পরে তিনি কখনো হেরা গুহায় যাননি। ছাহাবায়ে কেরামও কখনো এটি করেননি।
(গ) তারা সূরা জিন-এর ২৬ ও ২৭ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলেছেন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা গায়েবের খবর জানাতে পারেন। অতএব যে যা জানতে চায় আল্লাহ তাকে সেই জ্ঞান দিয়ে দেন’ (প্রশ্নোত্তর ১৭৫৩)।
অথচ উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর মনোনীত রাসূল ছাড়া তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কারু নিকট প্রকাশ করেন না। এ সময় তিনি সামনে ও পিছনে প্রহরী নিযুক্ত করেন’। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর রাসূলের নিকট ‘অহি’ প্রেরণ করেন এবং তাকে শয়তান থেকে নিরাপদ রাখেন। এই ‘অহি’-টাই হ’ল গায়েবের খবর, যা কুরআন ও হাদীছ আকারে আমাদের কাছে মওজুদ রয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ‘অহি’-র আগমন বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব কোয়ান্টামের গুরুরা চাইলেও গায়েবের খবর জানতে পারবেন না।
(ঘ) তারা সূরা বুরূজ-এর বুরূজ অর্থ করেন ‘রাশিচক্র’।
যাতে আল্লাহকে বাদ দিয়ে রাশিচক্র অনুযায়ী মানুষের ভাল-মন্দ ও শুভাশুভ নির্ধারণের বিষয়টি তাদের শিষ্যদের মনে গেঁথে যায়। অথচ এটি হিন্দু ও তারকা পূজারীদের শিরকী আক্বীদা মাত্র।
(ঙ) তারা সূরা আলে ইমরানের ১৯১ আয়াতটি তাদের আবিষ্কৃত মেডিটেশনের পক্ষে প্রমাণ হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন (প্রশ্নোত্তর ১৭৫৩)। ঐ সাথে একটি জাল হাদীছকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘণ্টার ধ্যান ৭০ বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম’ (প্রশ্নোত্তর ১৭২৪)। অথচ উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর সৃষ্টি বিষয়ে গভীর গবেষণা তাকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনায় উদ্বুদ্ধ করে’।
কোয়ান্টামের কথিত অন্তর্গুরুর কাছে যেতে বলে না। আর হাদীছটি হ’ল জাল। যা আদৌ রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী নয়। কোন কোন বর্ণনায় ৬০ বছর ও ১০০০ বছর বলা হয়েছে’ (সিলসিলা যঈফাহ হা/১৭১)।
পরিশেষে বলব, কোয়ান্টাম মেথডের পূরা চিন্তাধারাটাই হ’ল তাওহীদ বিরোধী এবং শিরক প্রসূত। যা মানুষের মাথা থেকে বেরিয়ে এলেও এর মূল উদ্গাতা হ’ল শয়তান।
মানুষকে জাহান্নামে নেবার জন্য মানুষের নিকট বিভিন্ন পাপকর্ম শোভনীয় করে পেশ করার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছেন (হিজর ৩৯)।
তবে সে আল্লাহর কোন মুখলেছ বান্দাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না (হিজর ৪০)।
শয়তান নিজে অথবা কোন মানুষের মাধ্যমে প্রতারণা করে থাকে। যেমন হঠাৎ করে শোনা যায়, অমুক স্থানে অমুকের স্বপ্নে পাওয়া শিকড়ে বা তাবীযে মানুষের সব রোগ ভাল হয়ে যাচ্ছে। ফলে দু’পাঁচ মাস যাবত দৈনিক লাখো মানুষের ভিড় জমিয়ে হাযারো মুসলমানের ঈমান হরণ করে হঠাৎ একদিন ঐ অলৌকিক চিকিৎসক উধাও হয়ে যায়। এদের এই ধোঁকার জালে আবদ্ধ হয়েছিল সর্বপ্রথম নূহ (আঃ)-এর কওম। যারা পরে আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যায়। আমরাও যদি শিরকের মহাপাপ থেকে দ্রুত তওবা না করি, তাহ’লে আমরাও তাঁর গযবে ধ্বংস হয়ে যাব। অতএব হে মানুষ! সাবধান হও!!(স.স.)
সূত্র: মাসিক আত-তাহরীক

কোরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণে স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা

🔘🔘🔘 কোরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণে স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা 🔘🔘🔘
সূচীপত্র
১- ভূমিকা
২- স্বপ্ন সম্পর্কে কিছু কথা
৩- স্বপ্ন দেখলে করণীয়
৪- মিথ্যা স্বপ্নের কথা বলা অন্যায়
৫- ভাল স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে
৬- কয়েকটি ভাল স্বপ্নের উদাহরণ
৭- স্বপ্ন দেখলে যা করতে হবে
৮- খারাপ স্বপ্ন দেখলে কি করবে?
৯- কে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেবে?
১০- স্বপ্নের ব্যাখ্যা যেভাবে করা হয় তা-ই সংঘটিত হয়
১১- তাবীরের বিভিন্ন প্রকার
১২- কোরআনের আয়াত দিয়ে স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার কয়েকটি দৃষ্টান্ত
১৩- হাদীস দিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যার কয়েকটি দৃষ্টান্ত
১৪- বিপরীত অর্থ গ্রহণ নীতিতে স্বপ্ন ব্যাখ্যার দৃষ্টান্ত
১৫- কয়েকটি প্রসিদ্ধ স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যার বিবরণ
১৬- মৃত ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখা
১৭- স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. এর কিছু বক্তব্য
১৮- ভাল স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেরীতে হয়
১৯- শেষ কথা
ভূমিকা
যার নিখুত সৃষ্টি কুশলতায় অস্তিত্ব লাভ করেছে এ বিশ্ব জাহান। যার অসীম কুদরতের অনুপম নিদর্শন চাঁদ-সুরুজ ও সিতারা-আসমান। যার করুণা স্নিগ্ধ লালন-প্রতিপালনে ধন্য সকল জড় উদ্ভিদ প্রাণ। সেই মহান রাব্বুল আলামীনের জন্যই আমার সকাল-সন্ধ্যার হামদ-সানা, আমার দিবস রজনীর স্তুতি-বন্দনা।
যার শুভাগমনে আঁধার ঘুচে মানবতার পূর্ব দিগন্তে এক নতুন সূর্যের উদয় হল। মানবতার মুক্তির জন্য মানুষেরই হাতে তায়েফের মাটি যার রক্তে রঞ্জিত হল; সেই নবী রাহমাতুল্লিল আলামীনের প্রতি আমার বিরহী আত্মার সালাত ও সালাম। মদীনা স্বপ্নে বিভোর আমার হৃদয়ের প্রেম-পয়গাম।
মানুষ স্বপ্ন দেখে। ভাল স্বপ্ন দেখে, বলে সুন্দর স্বপ্ন দেখেছি। দেখে খারাপ স্বপ্ন, বলে ভয়ানক এক স্বপ্ন দেখেছি। আবার কখনো বলে একটি বাজে স্বপ্ন দেখেছি।
আসলে স্বপ্ন কি? এ নিয়ে গবেষণা কম হয়নি, মানব সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। কেউ বলেছেন, এটা একটি মানসিক চাপ থেকে আসে। কেউ বলেছেন, শারীরিক বিভিন্ন ভারসাম্যের ব্যাঘাত ঘটলে এটা দেখা যায়, সে অনুযায়ী। কেউ বলেছেন, সারাদিন মনে যা কল্পনা করে তার প্রভাবে রাতে স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন আধুনিক মনোবিজ্ঞানেরও একটি বিষয়।
আবার অনেকে স্বপ্ন না দেখেও বলে এটা আমার স্বপ্ন ছিল। অথবা আমার জীবনের স্বপ্ন এ রকম ছিল না। মানে, মনের আশা, পরিকল্পনা। তাই স্বপ্নের অর্থ এখানে রূপক।
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মানুষের জন্য পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে এসেছে ইসলাম। এই ইসলাম মানুষের স্বপ্নের ব্যাপারেও উদাসীন থাকেনি। স্বপ্ন সম্পর্কে তার একটি নিজস্ব বক্তব্য আছে। তার এ বক্তব্য কোনো দার্শনিক বা বিজ্ঞানীর বক্তব্যের সাথে মিলে যাবে, এমনটি জরুরী নয়। মিলে গেলেও কোনো দোষ নেই।
স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা বিশেষজ্ঞ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সীরিন রহ. বলেছেন :
الرؤيا ثلاث : حديث النفس ، وتخويف الشيطان ، وبشرى من الله .
(رواه البخاري في التعبير)
স্বপ্ন তিন ধরনের হয়ে থাকে। মনের কল্পনা ও অভিজ্ঞতা। শয়তানের ভয় প্রদর্শন ও কুমন্ত্রণা ও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সুসংবাদ। (বর্ণনায় : বুখারী)
ইসলামে স্বপ্নের একটি গুরুত্ব আছে। নি:সন্দেহে এটা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এক চোখা বস্তুবাদীরা বলে থাকে, ‍‍‍‍‍‍মানুষ যখন ঘুমায়, তখন তার মস্তিস্ক তার স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করে। যাচাই-বাছাই করে, কিছু পুনর্বিন্যাস করে। তারপর স্মৃতির ফাইলে যত্ন করে রেখে দেয়। এই কাজটা সে করে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন। মস্তিস্কের এই কাজ-কর্মই আমাদের কাছে ধরা দেয় স্বপ্ন হিসেবে।‌‌”
কথাটা শুনতে মন্দ নয়। তবে এটি স্বপ্নের একটি প্রকার মাত্র। বাকী দু প্রকার কি আপনাদের মস্তিস্কে ধরা পড়ে? ইসলাম তো বলে স্বপ্ন তিন প্রকার।
হাদীসে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাজের পর মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসতেন। প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, গত রাতে তোমাদের কেউ কি কোনো স্বপ্ন দেখেছ?
আল-কোরআনে নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্বপ্ন, ইউসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্নের কথা উল্লেখ আছে। ইউসূফ আলাইহিস সালামের সময়ে মিশরের বাদশার স্বপ্ন, তাঁর জেলখানার সঙ্গীদের স্বপ্ন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বপ্ন নিয়ে তো আল কোরআনে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।
মিশরের বাদশা তার সভাসদের স্বপ্ন বিশেষজ্ঞদেরকে নিজ স্বপ্ন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। জানতে চেয়েছিল, সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা। তারা বলেছিল, এটা এলোমেলো অলীক স্বপ্ন। তারা এর ব্যাখ্যা দিতে পারল না।
নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন। নিজের পক্ষ থেকে নয়। আল্লাহ তাআলার শিখানো ইলম থেকে। (সূরা ইউসূফের ৩৬ থেকে ৪৯ আয়াত দ্রষ্টব্য)
আমি বক্ষমান বইতে কোরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যার কিছু মৌলিক ধারনা দেয়ার চেষ্টা করব। তবে কি স্বপ্ন দেখলে কি হয়, তা এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে না । এটা নির্দিষ্ট করে আলোচনা করা সম্ভবও নয়। মানে এটা বাজারে প্রচলিত কোনো খাবনামা নয়। স্বপ্ন সম্পর্কে মৌলিক কিছু আলোচনা ও একটি ধারনা দেয়ার প্রয়াস মাত্র।
স্বপ্ন দ্রষ্টার অবস্থা ভেদে একই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বিভিন্ন রকম হতে পারে।
স্বপ্ন তিন প্রকার:
এক. মনে মনে যা সারাদিন কল্পনা করে তার প্রভাবে ঘুমের মধ্যে ভাল-মন্দ কিছু দেখা। এগুলো আরবীতে আদগাছু আহলাম বা অলীক স্বপ্ন বলে।
দুই. শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রভাবে স্বপ্ন দেখা। সাধারণত এ সকল স্বপ্ন ভীতিকর হয়ে থাকে।
তিন. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ইশারা, ইঙ্গিত হিসাবে স্বপ্ন দেখা।
বিষয়টি উপরে বর্ণিত হাদীসেও উল্লেখ হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাটুকু কবুল করুন। বইটিকে পাঠকদের কল্যাণে গ্রহণ করুন। আর আমরা আমাদের সকল পাওনা ও প্রাপ্তি তার কাছেই আশা করি। তিনি মুহসিনদের সৎকর্ম ব্যর্থ হতে দেন না।
আব্দুল্লাহ শহীদ আ: রহমান
১৭ রজব ১৪৩১ হিজরী
৩০ জুন ২০১০ ইং
স্বপ্ন সম্পর্কে কিছু কথা
হাদীসে এসেছে :
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: "لم يبق من النبوة إلا المبشرات" قالوا: وما المبشرات؟ قال: "الرؤيا الصالحة" رواه البخاري.
في كتاب التعبير (باب المبشرات).
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, নবুওয়তে আর কিছু অবশিষ্ট নেই, বাকী আছে কেবল মুবাশশিরাত (সুসংবাদ)। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, মুবাশশিরাত কী? তিনি বললেন: ভাল স্বপ্ন। (বর্ণনায় : সহীহ বুখারী)
এ হাদীস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম:
এক. স্বপ্ন নবুওয়তের একটি অংশ। নবী ও রাসূলদের কাছে জিবরীল যেমন সরাসরি ওহী নিয়ে আসতেন, তেমনি স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নবী ও রাসূলদের কাছে প্রত্যাদেশ পাঠাতেন।
দুই. মুসলিম জীবনে স্বপ্ন শুধু একটি স্বপ্ন নয়। এটা হতে পারে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে স্বপ্নদ্রষ্টার প্রতি একটি বার্তা।
তিন. আল মুবাশশিরাত অর্থ সুসংবাদ। সঠিক স্বপ্ন যা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, তা স্বপ্ন দ্রষ্টার জন্য একটি সুসংবাদ।
হাদীসে এসেছে
وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: "إذا اقترب الزمان لم تكد رؤيا المؤمن تكذب، ورؤيا المؤمن جزء من ستة وأربعين جزءً من النبوة" متفق عليه،
وفي رواية: "أصدقكم رؤيا أصدقكم حديثاً".
الحديث رواه البخاري في التعبير (باب القيد في المنام) ومسلم في أول كتاب الرؤيا.
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দিন যত যেতে থাকবে, কিয়ামত নিকটে হবে, মুমিনদের স্বপ্নগুলো তত মিথ্যা হতে দূরে থাকবে। ঈমানদারের স্বপ্ন হল নবুওয়তের ছিচল্লিশ ভাগের একভাগ। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তোমাদের মধ্যে যে লোক যত বেশী সত্যবাদি হবে তার স্বপ্ন তত বেশী সত্যে পরিণত হবে।
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. মুমিনের জীবনে স্বপ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেয়ামত যত নিকটে আসবে ঈমানদারের স্বপ্ন তত বেশী সত্য হতে থাকবে।
দুই. ঈমানদারের জীবনে স্বপ্ন এত গুরুত্ব রাখে যে, তাকে নবুওয়তের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে।
তিন. মানুষ যত বেশী সততা ও সত্যবাদিতার চর্চা করবে সে ততবেশী সত্য স্বপ্ন দেখতে পাবে।
চার. যদি কেউ চায় সে সত্য স্বপ্ন দেখেব, সে যেন সৎ, সততা ও সত্যবাদিতার সাথে জীবন যাপন করে।
হাদীসে এসেছে
وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من رآني في المنام فسيراني في اليقظة -أو كأنما رآني في اليقظة- لا يتمثل الشيطان بي" متفق عليه.
الحديث رواه البخاري في التعبير (باب من رأى النبي صلى الله عليه وسلم في المنام) ومسلم في الرؤيا (باب قول النبي صلى الله عليه وسلم من رآني في المنام فقد رآني).
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে নিদ্রার মধ্যে আমাকে দেখে সে যেন বাস্তবেই আমাকে দেখেছে। কারণ, শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না। (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে স্বপ্নে দেখবে সে সত্যিকারভাবেই তাকে দেখেছে।
দুই. শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রভাবে মানুষ স্বপ্ন দেখে থাকে। শয়তান মানুষকে বিভিন্ন স্বপ্ন দেখাতে পারে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আকৃতি ধরে ধোকা দিতে পারে না।
তিন. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখা একটি সৌভাগ্য। খুব কম ঈমানদারই আছেন, যারা এ সৌভাগ্যটি অর্জন করেছেন।
স্বপ্ন দেখলে করণীয়
হাদীসে এসেছে
وعن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه أنه سمع النبي صلى الله عليه وسلم يقول: "إذا رأى أحدكم رؤيا يحبها فإنما هي من الله تعالى فليحمد الله عليها وليحدث بها"،
وفي رواية: "فلا يحدث بها إلا من يحب، وإذا رأى غير ذلك مما يكره فإنما هي من الشيطان، فليستعذ من شرها ولا يذكرها لأحد، فإنها لا تضره" متفق عليه.
الحديث رواه البخاري في كتاب التعبير (باب الرؤيا الصالحة من الله) ومسلم في أول كتاب الرؤيا.
আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন: তোমাদের কেউ যদি এমন স্বপ্ন দেখে যা সে পছন্দ করে, তাহলে জানবে যে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছে। তখন সে যেন আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করে ও অন্যদের কাছে বর্ণনা করে।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে,
এ স্বপ্নের কথা শুধু তাকে বলবে, যে তাকে ভালোবাসে।
আর যদি স্বপ্ন অপছন্দের হয়, তাহলে বুঝে নেবে এটা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়েছে। তখন সে শয়তানের ক্ষতি থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে আর এ স্বপ্নের কথা কারো কাছে বলবে না। কারণ খারাপ স্বপ্ন তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. যা কিছু ভাল স্বপ্ন, সেটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রভাবের কারণে দেখে থাকে।
দুই. ভাল স্বপ্ন দেখলে এমন ব্যক্তির কাছে বলা যাবে, যে তাকে ভালোবাসে। যে ভালোবাসে না, এমন ব্যক্তির কাছে কোনো স্বপ্নের কথা বলা যাবে না। হতে পারে সে ভাল স্বপ্নটির একটি খারাপ ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে দেবে।
তিন. ভাল স্বপ্ন দেখলে আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করতে হবে।
চার. খারাপ স্বপ্ন দেখলে কারো কাছে বলা উচিত নয়।
পাঁচ. খারাপ স্বপ্ন দেখলে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়া মাত্র আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে বলতে হবে আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম।
হাদীসে এসেছে :
عن أبي قتادة رضي الله عنه قال: قال النبي صلى الله عليه وسلم "الرؤيا الصالحة" وفي رواية "الرؤيا الحسنة من الله والحلم من الشيطان، فمن رأى شيئاً يكرهه فلينفث عن شماله ثلاثاً وليتعوذ من الشيطان، فإنها لا تضره" متفق عليه.
رواه البخاري في التعبير (باب الرؤيا الصالحة جزء من ستة وأربعين جزءاً) وأبواب أخرى وبدء الخلق (باب صفة إبليس وجنوده) ومسلم في أول كتاب الرؤيا.
আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: সুন্দর স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। কেউ স্বপ্নে খারাপ কিছু দেখলে বাম পাশে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করবে আর শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। ( এভাবে বলবে, আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম) তাহলে এ স্বপ্ন তাকে ক্ষতি করতে পারবে না। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. ভাল স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে।
দুই. খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে এসে থাকে।
তিন. খারাপ স্বপ্ন দেখলে সাথে সাথে তিনবার বাম দিকে থুথু ফেলে আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানের রাজীম বলতে হবে। তবে সত্যিকার থুথু ফেলবে না। মানে মুখ থেকে পানি নির্গত হবে না। শুধু আওয়াজ করবে। কেননা হাদীসে নাফাস শব্দ এসেছে। যার অর্থ এমন হাল্কা থুথু যাতে পানি বা শ্লেষ্মা নেই।
চার. এই আমলটা করলে খারাপ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না।
হাদীসে এসেছে
عن جابر رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: "إذا رأى أحدكم الرؤيا يكرهها فليبصق عن يساره ثلاثاً، وليستعذ بالله من الشيطان ثلاثاً، وليتحول عن جنبه الذي كان عليه" رواه مسلم.
في أول كتاب الرؤيا.
জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যদি তোমাদের কেউ এমন স্বপ্ন দেখে যা সে পছন্দ করে না, তাহলে তিনবার বাম দিকে থুথু দেবে। আর তিন বার শয়তান থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় চাবে। (আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম বলবে) আর যে পার্শ্বে শুয়েছিল, তা পরিবর্তন করবে। (অর্থাৎ পার্শ্ব পরিবর্তন করে শুবে) (বর্ণনায় : মুসলিম)
হাদীস থেকে আমরা শিখতে পারলাম :
এক. খারাপ স্বপ্ন দেখলে তিনবার বাম দিকে থুথু নিক্ষেপ করা ও তিনবার আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম বলা তারপর পার্শ্ব পরিবর্তন করে শোয়া সুন্নাত।
দুই. পার্শ্ব পরিবর্তন করা মানে হল, ডান কাতে শুয়ে থাকলে বাম দিকে ফিরবে। তেমনি বাম কাতে শুয়ে থাকলে ডানে ফিরবে।
মিথ্যা স্বপ্নের কথা বলা অন্যায়
হাদীসে এসেছে
عن أبي الأسقع واثلة بن الأسقع رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: "إن من أعظم الفرى أن يدعي الرجل إلى غير أبيه أو يرى عينه ما لم تر، أو يقول على رسول الله صلى الله عليه وسلم ما لم يقل" . رواه البخاري.
رواه البخاري في المناقب (الأنبياء)، (باب نسبة اليمن إلى إسماعيل).
আবুল আছকা ওয়াসেলা ইবনুল আছকা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সবচেয়ে বড় মিথ্যা হল, কোনো ব্যক্তি তার নিজের পিতা ব্যতীত অন্যের সন্তান বলে দাবী করা। যে স্বপ্ন সে দেখেনি তা বর্ণনা করা আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেননি তা তাঁর ব্যপারে বলা। (বর্ণনায় : সহীহ বুখারী)
হাদীস থেকে আমরা শিখতে পারলাম:
সবচয়ে বড় মিথ্যা হল তিনটি,
(ক) নিজের পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা বলে দাবী করা।
(খ) যে স্বপ্ন দেখেনি তা বানিয়ে বলা। অর্থ্যাৎ মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা করা।
(গ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেননি, তা তার কথা বলে চালিয়ে দেয়া।
যারা মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা করে আর মনে করে, এতে এমন কি ক্ষতি? তাদের জন্য এ হাদীস একটি সাবধান বাণী। এটাকে ছোট পাপ বলে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
সব ধরনের মিথ্যা-ই অন্যায়। এমনকি হাসি ঠাট্টা করে মিথ্যা বলাও পাপ। তবে মিথ্যার মধ্যে এ তিনটি হল খুবই মারাত্মক।
যে পিতা নয় তাকে পিতা বলে লেখা বা ঘোষণা দেয়া এমন অন্যায় যার মাধ্যমে পরিবার প্রথা ও বংশের উপর আঘাত আসে। আর মাতা-পিতার অবদানকে অস্বীকার করা হয়।
কেউ মিথ্যা স্বপ্নের বর্ণনা দিলে তার ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। আর যদি ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে তা সংঘটিত হয়ে যায়।
উদাহরণ :
এক ব্যক্তি ইমাম ইবনে সীরিন রহ. এর কাছে এসে বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমার হাতে যেন একটি কাঁচের পেয়ালা। সেটি ভেঙ্গে গেল কিন্তু তার পানি রয়ে গেছে।
ইবনে সীরিন রহ. বললেন, তুমি কিন্তু এ রকম কোনো স্বপ্ন দেখোনি। লোকটি রাগ হয়ে বলল, সুবহানাল্লাহ! (আমি মিথ্যে বলিনি)
ইবনে সীরিন রহ. বললেন, যদি স্বপ্ন মিথ্যা হয়, তাহলে আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না।
আর এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা হল, তোমার স্ত্রী মারা যাবে আর পেটের বাচ্চাটি জীবিত থাকবে।
এ কথা শোনার পর লোকটি বলল, আল্লাহর কসম! আমি আসলে কোনো স্বপ্ন দেখিনি।
এর কিছুক্ষণ পর তার একটি সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে এবং তাতে আর স্ত্রী মারা গেছে।
(ইমাম জাহাবী রহ. প্রণীত সীয়ার আল-আলাম আন নুবালা)
আরেকটি উদাহরণ:
এক ব্যক্তি ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে এসে বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি, জমিন তরু-তাজা সবুজ হয়েছে। এরপর আবার শুকিয়ে গেছে। আবার সবুজ-তরুতাজা হয়েছে, আবার শুকিয়ে গেছে।
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এর ব্যাখা হল তুমি প্রথমে মুমিন থাকবে পরে কাফের হয়ে যাবে। আমার মুমিন হবে, এরপর আবার কাফের হয়ে যাবে আর কাফের অবস্থায় তুমি মৃত্যু বরণ করবে।
এ কথা শুনে লোকটি বলল, আসলে আমি এ রকম কোনো স্বপ্ন দেখিনি। ওমর বাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন :
যে বিষয়ে তুমি প্রশ্ন করেছিলে তার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।
তোমার বিষয়ে ফয়সালা হয়ে গেছে যেমন ফয়সালা হয়েছিল, ইউসূফ আলাইহিস সালামের সাথীর ব্যাপারে।
(মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, বর্ণনার সনদ সহীহ)
তাই কখনো কাল্পনিক বা মিথ্যা স্বপ্ন বলা ও তার ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া ঠিক নয়।
ভাল স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে
হাদীসে এসেছে
عن أبي قتادة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: "الرؤيا الصالحة من الله، والحلم من الشيطان، فإذا رأى أحدكم ما يحب فلا يحدث به إلا من يحب. وإذا رأى ما يكره فليتعوذ بالله من الشيطان، ولينفث عن شماله ثلاثاً، ولا يحدث بها أحداً فإنها لن تضره" متفق عليه.
আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ভাল ও সুন্দর স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। যদি কেউ ভাল স্বপ্ন দেখে তাহলে তা শুধু তাকেই বলবে যে তাকে ভালোবাসে। অন্য কাউকে বলবে না।
আর যদি স্বপ্নে খারাপ কিছু দেখে তাহলে শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে। ( বলবে, আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম) এবং বাম দিকে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করবে। আর কারো কাছে স্বপ্নের কথা বলবে না। মনে রাখবে এ স্বপ্ন তার ক্ষতি করতে পারবে না। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. ভাল স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে।
দুই. খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে এসে থাকে।
তিন. খারাপ স্বপ্ন দেখলে সাথে সাথে তিনবার বাম দিকে থুথু ফেলে আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম বলতে হবে। তবে সত্যিকার থুথু ফেলবে না। মানে মুখ থেকে পানি নির্গত হবে না। শুধু আওয়ায করবে। কেননা হাদীসে নাফাস শব্দ এসেছে। যার অর্থ এমন হাল্কা থুথু যাতে পানি বা শ্লেষ্মা নেই।
চার. এই আমলটুকু করলে খারাপ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না।
পাঁচ. খারাপ স্বপ্ন দেখলে কারো কাছে তা বর্ণনা করবে না।
ছয়. ভাল স্বপ্ন দেখলে তার কাছেই বর্ণনা করবে যে তাকে ভালোবাসে। শত্রু ভাবাপন্ন বা হিংসুক ধরনের কারো কাছে ভাল স্বপ্নও বর্ণনা করতে নেই। কারণ, হতে পারে ভাল স্বপ্নটির একটি খারাপ ব্যাখ্যা সে শুনিয়ে দেবে। ফলে অস্থিরতা, দু:চিন্তা ও উদ্বেগ বেড়ে যাবে।
দেখুন ইউসুফ আলাইহিস সালাম স্বপ্ন দেখেছিলেন:
যখন ইউসুফ তার পিতাকে বলল, হে আমার পিতা, আমি দেখেছি এগারটি নক্ষত্র, সূর্য ও চাঁদকে, আমি দেখেছি তাদেরকে আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায়।’সে বলল, হে আমার পুত্র, তুমি তোমার ভাইদের নিকট তোমার স্বপ্নের বর্ণনা দিও না, তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন।’(সূরা ইউসুফ, আয়াত ৪-৫)
এ আয়াতে আমরা দেখলাম ইউসুফ আলাইহিস সালাম স্বপ্ন দেখে তার পিতাকে বর্ণনা করলেন। আর পিতা আল্লাহ তাআলার নবী ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তাকে স্বপ্নের কথা নিজ ভাইদের বলতে নিষেধ করলেন। কারণ, ভাইয়েরা তাকে ভালোবাসত না। বরং হিংসা করত।
কয়েকটি ভাল স্বপ্নের উদাহরণ
আল্লাহ তাআলা বলেন:
যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নের মধ্যে তাদেরকে স্বল্প সংখ্যায় দেখিয়েছিলেন। আর তোমাকে যদি তিনি তাদেরকে বেশি সংখ্যায় দেখাতেন, তাহলে অবশ্যই তোমরা সাহসহারা হয়ে পড়তে এবং বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করতে। কিন্তু আল্লাহ নিরাপত্তা দিয়েছেন। নিশ্চয় অন্তরে যা আছে তিনি সে সব বিষয়ে অবগত। (সূরা আনফাল : ৪৩)
বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে আল্লাহ তাআলা তার রাসূলকে বিজয় লাভের সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাকে শত্রু বাহিনীর সংখ্যা অনেক কম করে দেখিয়েছেন। বেশি করে দেখালে তিনি হয়ত ভয় পেয়ে যেতেন।
তাই এটি একটি ভাল স্বপ্ন।
এভাবে আল্লাহ তাআলা স্বপ্নের মাধ্যমে তার নবী ও রাসূলদের কাছে ওহী প্রেরণ করতেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
অবশ্যই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে স্বপ্নটি যথাযথভাবে সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন। তোমরা ইনশাআল্লাহ নিরাপদে তোমাদের মাথা মুণ্ডন করে এবং চুল ছেঁটে নির্ভয়ে মসজিদুল হারামে অবশ্যই প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ জেনেছেন যা তোমরা জানতে না। সুতরাং এ ছাড়াও তিনি দিলেন এক নিকটবর্তী বিজয়। (সূরা ফাতাহ : ২৭)
আয়াত থেকে আমরা জানতে পারলাম, আল্লাহ তাআলার তাঁর রাসূলকে মক্কা জয় করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আর সে স্বপ্ন আল্লাহ তাআলাই বাস্তবায়ন করেছিলেন।
এমনিভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কোরআনে মিশরের বাদশার স্বপ্ন বর্ণনা করেছেন। সে স্বপ্নের সুন্দর ব্যাখ্যা করেছিলেন, নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম। বিষয়টি আল কোরআনের সূরা ইউসুফের ৪৩ আয়াত থেকে ৫৫ আয়াত পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে এবং সেখানে সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে।
এর আগে সূরার ৩৬ আয়াত থেকে ৪২ আয়াত পর্যন্ত ইউসুফ আলাইহিস সালামের জেল জীবনের দুজন সাথীর স্বপ্ন ও ইউসুফ আলাইহিস সালাম কর্তৃক তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি বিষয় তা আল-কোরআনে নবী ইউসুফের ভাষায় বলা হয়েছে এভাবে:
হে আমার রব, আপনি আমাকে রাজত্ব দান করেছেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিখিয়েছেন। হে আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা! দুনিয়া ও আখিরাতে আপনিই আমার অভিভাবক, আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দিন এবং নেককারদের সাথে আমাকে যুক্ত করুন (সূরা ইউসুফ : ১০১)
এমনিভাবে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ ইবনে আব্দে রাব্বিহী ও ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুমা স্বপ্নে আজান দেখেছিলেন। আর তাদের স্বপ্নে দেখা আজান-কেই নামাজের বর্তমান আজান ও ইকামত হিসাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
তাদের সুন্দর স্বপ্নগুলো এভাবেই ইসলামের নিদর্শন হিসাবে বাস্তবে রূপ লাভ করেছে অনন্তকালের জন্য।
আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, ভালো ও সুন্দর স্বপ্নগুলো কখনো হুবহু বাস্তব রূপে দেখা যায় আবার কখনো রূপকভাবে ভিন্ন আকৃতিতে ।
যেমন আজান দেয়ার পদ্ধতি সংক্রান্ত স্বপ্ন হুবহু দেখানো হয়েছে। অপরদিকে ইউসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্নগুলো ভিন্ন আকৃতিতে রূপকভাবে দেখানো হয়েছে।
স্বপ্ন দেখলে যা করতে হবে
যদি কেউ ভাল স্বপ্ন দেখে তাহলে তার তিনটি কাজ করতে হবে :
এক. আল্লাহ তাআলার প্রশংসা স্বরূপ আল হামদুলিল্লাহ বলতে হবে।
দুই. এটা অন্যকে সুসংবাদ হিসাবে জানাবে।
তিন. স্বপ্ন সম্পর্কে এমন ব্যক্তিদেরকে জানাবে যারা তাকে ভালোবাসে।
হাদীসে এসেছে :
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه أنه سمع النبي صلى الله عليه وسلم يقول: "إذا رأى أحدكم رؤيا يحبها، فإنما هي من الله، فليحمد الله عليها، وليحدث بها، وإذا رأى غير ذلك مما يكره، فإنما هي من الشيطان، فليستعذ من شرها، ولا يذكرها لأحد فإنها لا تضره".
رواه البخاري في كتاب التعبير ، وروى مسلم من حديث أبي قتادة في كتاب الرؤيا وفيه : فإن رأى رؤيا حسنة فليبشر، ولا يخبر إلا من يحب.
আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু্ আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছেন, যখন তোমাদের কেউ এমন স্বপ্ন দেখে যা তার ভাল লাগে, তাহলে সে বুঝে নেবে এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। তখন সে এ স্বপ্নের জন্য আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করবে আর অন্যকে এ ব্যাপারে জানাবে।
আর যদি অন্য স্বপ্ন দেখে যা সে পছন্দ করে না, তাহলে বুঝে নেবে এটা শয়তানের পক্ষ থেকে। তখন সে এ স্বপ্নের ক্ষতি থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। (আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম বলবে) এবং কাউকে এ স্বপ্নের কথা বলবে না। মনে রাখবে এ স্বপ্ন তাকে ক্ষতি করবে না। (সহীহ বুখারী)
স্বপ্ন ভাল হলে তা শুভাকাংখী ব্যতীত অন্য কারো কাছে বলা ঠিক নয়। এ কারণে ইয়াকুব আ. তার ছেলে ইউসূফ কে বলেছিলেন :
হে আমার বৎস! তোমার স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের কাছে বলো না। (সূরা ইউসুফ : ৫)
খারাপ স্বপ্ন দেখলে কি করবে?
হাদীসে এসেছে
عن أبي قتادة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: "الرؤيا الصالحة من الله، والحلم من الشيطان، فإذا رأى أحدكم ما يحب فلا يحدث به إلا من يحب. وإذا رأى ما يكره فليتعوذ بالله من الشيطان، ولينفث عن شماله ثلاثاً، ولا يحدث بها أحداً فإنها لن تضره" متفق عليه.
আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ভাল ও সুন্দর স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে আর খারাপ স্বপ্ন হয় শয়তানের পক্ষ থেকে। যদি কেউ ভাল স্বপ্ন দেখে, তাহলে তা শুধু তাকেই বলবে, যে তাকে ভালোবাসে। অন্য কাউকে বলবে না। আর কেউ যদি স্বপ্নে খারাপ কিছু দেখে, তা হলে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। (আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম বলবে) এবং বাম দিকে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করবে। আর কারো কাছে স্বপ্নের কথা বলবে না। মনে রাখবে, এ স্বপ্ন তার কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
খারাপ স্বপ্ন দেখলে যা করতে হবে :
এক. এই খারাপ স্বপ্নের ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। এভাবে সকল প্রকার ক্ষতি থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত।
দুই. শয়তানের অনিষ্ট ও কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। এবং এর জন্য আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম পড়তে হবে। কারণ, খারাপ স্বপ্ন শয়তানের কুপ্রভাবে হয়ে থাকে।
তিন. বাঁ দিকে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করতে হবে। এটা করতে হবে শয়তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ ও তার চক্রান্ত-কে অপমান করার জন্য ।
চার. যে কাতে ঘুমিয়ে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে তা পরিবর্তন করে অন্য কাতে শুতে হবে। অবস্থাকে বদলে দেয়ার ইঙ্গিত স্বরূপ এটা করা হয়ে থাকে।
পাঁচ. খারাপ স্বপ্ন দেখলে কারো কাছে বলবে না। আর নিজেও এর ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করবে না।
হাদীসে এসেছে
جاء رجل إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقال : يا رسول الله ! رأيت في المنام كأن رأسي قطع . قال : فضحك النبي صلى الله عليه وسلم وقال " إذا لعب الشيطان بأحدكم في منامه . فلا يحدث به الناس " . وفي رواية أبي بكر " إذا لعب بأحدكم " ولم يذكر الشيطان .
الراوي: جابر بن عبد الله. المحدث: مسلم - المصدر: صحيح مسلم - الصفحة أو الرقم: 2268
خلاصة حكم المحدث: صحيح
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমার মাথা কেটে ফেলা হয়েছে। এ কথা শুনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে ফেললেন। আর বললেন : ঘুমের মধ্যে শয়তান তোমাদের কারো সাথে যদি দুষ্টুমি করে, তবে তা মানুষের কাছে বলবে না। (বর্ণনায় : মুসলিম)
হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. সাহাবীগণ কোনো স্বপ্ন দেখলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার ব্যাখ্যা জানতে চাইতেন। তারা এভাবে কোনো স্বপ্নকে অযথা মনে না করে এর গুরুত্ব দিতেন।
দুই. খারাপ স্বপ্ন দেখলে তা কাউকে বলতে নেই।
তিন. খারাপ ও নেতিবাচক স্বপ্ন শয়তানের একটি কুমন্ত্রণা।
কে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেবে?
এমন ব্যক্তিই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেয়ার অধিকার রাখে, যে কোরআন ও হাদীসের জ্ঞান সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও স্বপ্ন ব্যাখ্যার মূলনীতি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল। সাথে সাথে তাকে মানব-দরদী ও সকলের প্রতি কল্যাণকামী মনোভাবের অধিকারী হতে হবে।
তাই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إذا رأى أحدكم رؤيا فلا يحدث بها إلا ناصحا أو عالما
الراوي: أنس بن مالك المحدث: الألباني - المصدر: السلسلة الصحيحة - الصفحة أو الرقم: 120
خلاصة حكم المحدث: صحيح
তোমাদের কেউ স্বপ্ন দেখলে তা ন আলেম কিংবা কল্যাণকামী ব্যতীত কারো কাছে তা বর্ণনা করবে না। (বর্ণনায় : মুসতাদরাক, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
শায়খ আব্দুর রহমান আস সাদী রহ. বলতেন, স্বপ্নের ব্যাখ্যা একটি শরয়ী বিদ্যা। এটা শিক্ষা করা, শিক্ষা দেয়া ও চর্চার করলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রতিদান পাওয়া যাবে। আর স্বপ্নের ব্যাখ্যা ফতোয়ার মর্যাদা রাখে।
তাইতো দেখি ইউসুফ আলাইহিস সালাম স্বপ্নের ব্যাখ্যাকে ফতোয়া বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন তিনি তার জেল সঙ্গী দুজনেকে তাদের জানতে চাওয়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানিয়ে বলেছিলেন :
তোমরা দুজনে যে বিষয়ে ফতোয়া চেয়েছিলে তার ফয়সালা হয়ে গেছে। (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৪১)
স্বপ্নের ব্যাখ্যা যেভাবে করা হয় তা-ই সংঘটিত হয়
হাদীসে এসেছে
عن أنس رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: "إن الرؤيا تقع على ما تعبر، فإذا رأى أحدكم رؤيا فلا يحدث بها إلا ناصحاً أو عالماً.
المستدرك: (4/391) وقال صحيح الإسناد ولم يخرجاه، ووافقه الذهبي، وصححه أيضاً الألباني في سلسلة الأحاديث الصحيحة (120).
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: স্বপ্নের যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয় সেভাবে তা বাস্তবায়িত হয়। যখন তোমাদের কেউ স্বপ্ন দেখবে তখন আলেম অথবা কল্যাণকামী ব্যতীত কারো কাছে তা বর্ণনা করবে না। (বর্ণনায় : মুসতাদরাক, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
أخرج أبو داود والترمذي وابن ماجه، عن أبي رزين العقيلي، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: "الرؤيا على رجل طائر، ما لم تعبر، فإذا عبرت وقعت.
أخرجه أبو داود: (4/305) كتاب الأدب - باب ما جاء في الرؤيا - رقم (5020).
আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ আবু রাযীন আল উকাইলী থেকে বর্ণনা করেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: স্বপ্ন হল, উড়ন্ত পা- এর মত। (যা ভাল ও খারাপ উভয়ের সম্ভাবনা রাখে) যতক্ষণ না তার ব্যাখ্যা করা হয়। যখন একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয় তখন তা বাস্তবায়িত হয়।
হাদীসে আরো এসেছে -
عن عائشة زوج النبي صلى الله عليه وسلم قالت كانت امرأة من أهل المدينة لها زوج تاجر يختلف، فكانت ترى رؤيا كلما غاب زوجها وقلما يغيب إلا تركها حاملاً، فتأتي رسول الله- صلى الله عليه وسلم - فتقول: إن زوجي خرج تاجراً فتركني حاملاً، فرأيت فيما يرى النائم أن سارية بيتي انكسرت، وأني ولدت غلاماً أعور، فقال رسول الله- صلى الله عليه وسلم - خير يرجع زوجك عليك، إن شاء الله تعالى صالحاً، وتلدين غلاماً براً - فكانت تراها مرتين أو ثلاثاً، كل ذلك تأتي رسول الله- صلى الله عليه وسلم- فيقول ذلك لها، فيرجع زوجها وتلد غلاماً، فجاءت يوما كما كانت تأتيه ورسول الله - صلى الله عليه وسلم - غائب، وقد رأت تلك الرؤيا فقلت لها: عم تسألين رسول الله - صلى الله عليه وسلم -يا أمة الله؟.
فقالت: رؤيا كنت أراها فآتي رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فأسأله عنها، فيقول خيراً، فيكون كما قال، فقلت: فأخبريني ما هي؟ قالت حتى يأتي رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فأعرضها عليه كما كنت أعرض، فوالله ما تركتها حتى أخبرتني، فقلت والله لئن صدقت رؤياك ليموتن زوجك وتلدين غلاماً فاجراً، فقعدت تبكي، فقال لها: ما لها يا عائشة؟ فأخبرته الخبر وما تأولت لها، فقال رسول الله - صلى الله عليه وسلم - مه يا عائشة إذا عبرتم للمسلم الرؤيا، فاعبروها على خير، فإن الرؤيا تكون على ما يعبرها صاحبها، فمات والله زوجها ولا أراها إلا ولدت غلاماً فاجراً .
الدارمي: (2/174) - رقم (2163) وحسنه ابن حجر في الفتح (12/450) بيد أن في إسناده محمد بن إسحاق وهو يدلس ولم يصرح بالتحديث.
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মদীনার অধিবাসী এক মহিলার স্বামী ছিল ব্যবসায়ী। ব্যবসায়িক কাজে বিভিন্ন দেশে আসা যাওয়া করত সে। যখনই তার স্বামী বিদেশে যেত তখনই সে নারী স্বপ্ন দেখত। আর তার স্বামী সর্বদা তাকে গর্ভবতী রেখে যেত। একদিন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, আমার স্বামী সফরে গেছে। আমি গর্ভবতী। আমি স্বপ্ন দেখলাম, আমার ঘরের চৌকাঠ ভেঙ্গে গেছে। আর আমি একটি এক চোখ কানা সন্তান প্রসব করেছি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ভাল স্বপ্ন দেখেছো। ইনশা আল্লাহ তোমার স্বামী তোমার কাছে সহীহ-সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসবে আর তুমি একটি সুস্থ-সুন্দর সন্তান প্রসব করবে।
এভাবে সে দু বার বা তিনবার স্বপ্ন দেখেছে। আর প্রতিবারই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসেছে। তিনি প্রতিবার এরকম ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। আর প্রতিবার সে রকমই বাস্তবায়িত হয়েছে।
একদিন মহিলা আগের মতই আসল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন অনুপস্থিত ছিলেন। সে স্বপ্ন দেখেই এসেছে।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর বান্দী! তুমি রাসুলুল্লাহর নিকট কী জিজ্ঞেস করবে?
সে বলল, আমি একটি স্বপ্ন প্রায়ই দেখি। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসি। তিনি সুন্দর ব্যাখ্যা দেন। সেটাই বাস্তবে পরিণত হয়।
আমি বললাম, তুমি আমাকে বল, কী স্বপ্ন দেখেছো? সে বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসুক, তারপর বলব।
আমি তাকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলাম স্বপ্নটি বলার জন্য- যেমনটি আমার অভ্যাস। অবশেষে সে আমাকে স্বপ্নের কথা বলতে বাধ্য হল। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! তোমার স্বপ্ন যদি সত্যি হয়, তাহলে তোমার স্বামী মারা যাবে। আর তুমি একটি অপূর্ণাঙ্গ বা অসুস্থ ছেলে প্রসব করবে।
তখন মহিলাটি বসে কাঁদতে লাগল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে বললেন: হে আয়েশা! এর কি হয়েছে?
তখন আমি পুরো ঘটনা ও স্বপ্ন সম্পর্কে আমার দেয়া ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানালাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: হে আয়েশা এটা কী করলে? যখন কোনো মুসলমানের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করবে তখন সুন্দর ও কল্যাণকর ব্যাখ্যা দেবে। মনে রাখবে স্বপ্নের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়, বাস্তবে তাই সংঘটিত হয়।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন : আল্লাহ তাআলার কি ইচ্ছা জানি না। মহিলাটির স্বামী মারা গেল আর দেখলাম সে একটি অসুস্থ অপূর্ণাঙ্গ ছেলে প্রসব করল। (বর্ণনায় : দারামী। ইবনে হাজার রহ. হাদীসটিকে হাসান বলে অভিহিত করেছেন।)
হাদীস থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল :
এক. স্বপ্ন বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যাকে তাকে স্বপ্নের কথা বলা উচিত নয়।
দুই. সর্বদা আলেম, শুভাকাংখীর কাছে স্বপ্নের কথা বলবে। যে শুভাকাংখী নয় তার কাছে কোনো ধরনের স্বপ্নের কথা বলবে না।
তিন. স্বপ্ন একটি উড়ন্ত পায়ের মত। এ কথার অর্থ হল শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা পা যেমন যে কোনো সময় মাটিতে রাখা যায় আবার নীচে আগুন থাকলে তাতেও রাখা যায়। স্বপ্ন এমনই, এর ব্যাখ্যা ভাল করা যায় আবার খারাপও করা যায়। যে ব্যাখ্যাই করা হোক, সেটিই সংঘটিত হবে।
চার. মদীনার এই মহিলাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে আসতেন। স্বপ্নটি বাহ্যিক দৃষ্টিতে খারাপ হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাল ও সুন্দর ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন।
তাই স্বপ্ন দ্রষ্টার পরিচিতদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে ভাল আলেম তার কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া উচিত।
পাঁচ. প্রশ্ন হতে পারে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কেন এ ধরনের ব্যাখ্যা দিলেন? এর উত্তর হল :
(ক) এ মহিলার স্বপ্নের ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কীভাবে করেছেন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তা জানতেন না। তাই তিনি নিজের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন।
(খ) আয়েশা রা. স্বপ্নের বাহ্যিক দিক তাকিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ঘরের চৌকাঠ দ্বারা স্বামী বুঝেছেন। আর এক চোখ অন্ধ সন্তান দ্বারা অপূর্ণাঙ্গ সন্তান বুঝেছেন।
(গ) ‌স্বপ্নের খারাপ বা অশুভ ব্যাখ্যা করা অনুচিত।স্বপ্ন ব্যাখ্যার এ মূলনীতির কথা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা আগে থেকে জানতেন না। এ ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জানিয়েছেন। এবং তিনি জেনেছেন।
(ঘ) এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা এভাবে করা যেত, যা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন। তাহল: ঘরের চৌকাঠ ভেঙ্গে যাওয়ার অর্থ হল, ঘর প্রশস্ত হবে। প্রাচুর্য ও সচ্ছলতা আসবে। আর এক চোখ কানা সন্তানের অর্থ হল, সন্তানটি তার চোখ দিয়ে শুধু ভাল বিষয় দেখবে।
এটা হল দূরবর্তী ব্যাখ্যা। আর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা করেছেন নিকটবর্তী ব্যাখ্যা।
ছয়. যার কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে, তিনি যদি জানেন, এর ব্যাখ্যা খারাপ তবে তিনি তা বলবেন না। যথাসম্ভব ভাল ব্যাখ্যা করে দেবেন। নয়তো চুপ থাকবেন। অথবা বলবেন, আল্লাহ ভাল জানেন।
সায়ীদ ইবনে মানসূর বর্ণনা করেন, আতা রহ. সব সময় বলতেন : স্বপ্নের ব্যাখ্যা যা দেয়া হয়, সেটাই সংঘটিত হয়। (ফাতহুল বারী)
প্রশ্ন হতে পারে তাহলে তাকদীরের ব্যাপারটা কি হবে?
উত্তর সোজা। তাকদীরে এভাবেই লেখা আছে যে, অমুক ব্যক্তি এভাবে ব্যাখ্যা করবে। আর তাই সংঘটিত হবে। কিন্তু আমাদের কর্তব্য হবে, কখনো খারাপ বা অশুভ ব্যাখ্যা না দেয়া। তাকদীরে কি আছে আমরা তা জানি না।
এ জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কোনো মানুষের কাছে স্বপ্নের কথা বলতে নিষেধ করেছেন।
স্বপ্নের কথা শুধু তাকে বলা যাবে যে আলেম, বন্ধু, শুভাকাংখী ও কল্যাণকামী। এ ছাড়া অন্য কারো কাছে নয়।
আরেকটি ঘটনা :
এক মহিলা একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে ইমাম ইবনে সীরিন রহ.-এর শিক্ষা মজলিসে আসল। এসে তিনি ইমামের ছাত্রদের কাছে জিজ্ঞেস করল, ইমাম সাহেব কোথায়? ইমাম সাহেবের একজন বোকা ছাত্র বলল, আপনি তার কাছে কেন এসেছেন?
মহিলাটি বলল, আমি এ ছেলেটির ব্যাপারে একটি স্বপ্ন দেখেছি, তার ব্যাখ্যা জানার জন্য এসেছি।
ছাত্রটি বলল, কি স্বপ্ন দেখেছেন? মহিলাটি বলল, আমি দেখেছি আমার এ ছেলেটি সাগর থেকে পানি পান করছে।
ছাত্রটি তাড়াতাড়ি ব্যাখ্যা দিল, বলল, তাহলে তো সে পেট ফুলে মারা যাবে।
তৎক্ষনাৎ শিশুটির পেট ফুলে উঠল। আর চিৎকার করে মারা গেল।
মহিলাটি কাঁদা শুরু করল। এরই মধ্যে ইমাম সাহেব এসে পড়লেন। ঘটনা শুনে তিনি বললেন: যদি তুমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা না করে ছেড়ে দিতে তাহলে ছেলেটি এ দেশের সবচেয়ে বড় আলেম ও বিদ্যান হত।
সাগরের অর্থ শুধু পানের অযোগ্য নোনা পানিই নয়। সাগরের ব্যাখ্যা হল, মনি, মুক্তা, হীরা, প্রবাল।
কাজেই যিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করবেন তিনি সব সময় ইতিবাচক ও কল্যাণকর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবেন।
(আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া : শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আস সাদহান)
তাবীরের বিভিন্ন প্রকার
তাবীর মানে স্বপ্ন ব্যাখ্যা করা। যার মাধ্যমে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা হয় তার বিবেচনায় কয়েক প্রকার হয়ে থাকে।
ইমাম বগভী রহ. বলেন: স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার দিক দিয়ে কয়েক প্রকার হতে পারে।
প্রথমত: আল কোরআনের আয়াত দিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান করা।
দ্বিতীয়ত: হাদীসে রাসূল দিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা।
তৃতীয়ত: মানুষে মাঝে প্রচলিত বিভিন্ন প্রসিদ্ধ উক্তি দিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা।
চতুর্থত: কখনো বিপরীত অর্থ গ্রহণ নীতির আলোকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা।
কোরআনের আয়াত দিয়ে স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার কয়েকটি দৃষ্টান্ত
স্বপ্নে রশি দেখার অর্থ হল, ওয়াদা, অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি।
এ ব্যাখ্যাটি আল কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াত থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
তোমরা আল্লাহ তাআলার রশিকে শক্তভাবে ধারণ করো। (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)
স্বপ্নে নৌকা বা জাহাজ দেখার ব্যাখ্যা হল মুক্তি পাওয়া।
এ অর্থটি আল কোরআনের এ আয়াত থেকে নেয়া হয়েছে।
আমি তাকে উদ্ধার করেছি এবং উদ্ধার করেছি জাহাজের আরোহীদের। (সূরা আল আনকাবুত : ১৫)
স্বপ্নে কাঠ দেখার ব্যাখ্যা হল, মুনাফেকী বা কপটতা। এ ব্যাখ্যাটি আল কোরআনের এ আয়াত থেকে নেয়া হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেছেন :
যেন তারা দেয়ালে ঠেস দেয়া কাঠের মতই। (সূরা আল মুনাফিকুন: ৪)
পাথর স্বপ্ন দেখলে তার ব্যাখ্যা হবে অন্তরের কঠোরতা ও পাষন্ডতা।
এ ব্যাখ্যাটি আল কোরআনের এ আয়াত থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তাআলা বলেন:
অত:পর তোমাদের অন্তরগুলো কঠিন হয়ে গেল, যেন তা পাথরের মত কিংবা তার চেয়েও শক্ত। (সূরা আল বাকারা: ৭৪)
যদি স্বপ্নে রোগ-ব্যধি দেখা হয়, তাহলে তার ব্যাখ্যা হবে মুনাফিক। কারণ, আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেছেন :
তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যধি। (সূরা আল বাকারা, আয়াত ১০)
যদি স্বপ্নে গোশত খেতে দেখে তাহলে তার অর্থ হতে পারে গীবত বা পরনিন্দা। কেননা গীবত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:
তোমাদের কেউ কি পছন্দ করবে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাবে? (সূরা আল হুজুরাত: ১৩)
এই যে ব্যাখ্যার কথাগুলো বলা হল, এগুলো যে এমন হতেই হবে তা জরুরী নয়। আবার সকলের ব্যাপারে ব্যাখ্যা একটিই হবে, তাও ঠিক নয়। একজন রোগীর স্বপ্ন আর সুস্থ মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা এক রকম হবে না। যদিও স্বপ্ন এক রকম হয়। তেমনি একজন মুক্ত মানুষ ও একজন বন্দী মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা এক রকম হবে না। স্বপ্নের ব্যাখ্যায় যেমন স্বপ্ন দ্রষ্টার অবস্থা লক্ষ্য করা হবে তেমনি স্বপ্নে যা দেখেছে তার অবস্থাও দেখতে হবে। যেমন কেউ স্বপ্নে দড়ি বা রশি দেখল। একজন স্বপ্নে দেখল সে একটি মজবুত রশি পেয়েছে। যা ছেড়া যাচ্ছে না। আরেক জন দেখল, সে একটা রশি ধরেছে কিন্তু তা ছিল নরম। দুটো স্বপ্নের ব্যাখ্যার মধ্যে বিশাল পার্থক্য হবে।
এক ব্যক্তি ইমাম মুহাম্মাদ বিন সীরিন রহ. এর কাছে বলল, আমি স্বপ্ন দেখলাম যে আমি আজান দিচ্ছি। তিনি বললেন, এর ব্যাখ্যা হল, তুমি হজ করবে।
আরেক ব্যক্তি এসে বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি আজান দিচ্ছি। তিনি বললেন, এর অর্থ হল, চুরির অপরাধে তোমার হাত কাটা যাবে।
লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আপনি একই স্বপ্নের দু ধরনের ব্যাখ্যা করলেন?
তিনি বললেন, প্রথম লোকটি নেক আমল প্রিয়। সে ভাল কাজ করে থাকে। সে জন্য তার স্বপ্নের ব্যাখ্যা নেক আমল হতে পারে। আমি আল কোরআনের আয়াত -
তুমি মানুষের মাঝে হজের জন্য আজান তথা এলান দাও। (সূরা হজ্জ:২৭)
আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছে পাপাচারী। তাই তার স্বপ্নের ব্যাখা পাপের শাস্তিই মানায়। তাই আমি আল কোরআনের আয়াত
অত:পর এক মুয়াজ্জিন (ঘোষণা কারী) আজান (ঘোষণা) দিল, হে কাফেলা! তোমরা তো চোর। (সূরা ইউসুফ : ৭০)
হাদীস দিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যার কয়েকটি দৃষ্টান্ত
স্বপ্নে কাক দেখার ব্যাখ্যা হল, পাপাচারী পুরুষ। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাকের নাম রেখেছেন ফাসেক। মানে, পাপী।
তেমনি ইঁদুর স্বপ্নে দেখার ব্যাখ্যা হল, পাপাচারী নারী। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইঁদুরের নাম রেখেছেন, ফাসেকা। মানে পাপাচারী মহিলা।
স্বপ্নে পাঁজর বা পাঁজরের হাড় দেখলে এর ব্যাখ্যা হবে, নারী। কারণ, নারীকে পাঁজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে হাদীসে এসেছে।
এমনিভাবে কাঁচের পান-পাত্র স্বপ্ন দেখার ব্যাখ্যা হল, নারী। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাঁচের পান-পাত্র-কে নারীর রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন:
হে আনজাশা! আরে আস্তে চল, নয়তো কাঁচের পান-পাত্রগুলো ভেঙ্গে যাবে। (বর্ণনায় : মুসলিম)
এখানে কাঁচের পান-পাত্র বলতে তিনি সফর সঙ্গী মেয়েদের বুঝিয়েছেন। মানে তাড়াতাড়ি হাটলে মেয়েরা পিছনে পড়ে যাবে। তাই তাদের জন্য তিনি ধীরে ধীরে পথ চলতে বললেন।
বিপরীত অর্থ গ্রহণ নীতিতে স্বপ্ন ব্যাখ্যার দৃষ্টান্ত
কোনো ব্যক্তি স্বপ্নে ভীতিকর কিছু দেখল বা ভয় পেল। তার অবস্থার বিবেচনায় এর ব্যাখ্যা হতে পারে শান্তি ও নিরাপত্তা।
যেমন আল্লাহর তাআলার বাণী
তিনি তাদের ভয়-ভীতিকে শান্তি ও নিরাপত্তায় পরিবর্তন করে দেবেন। (সূরা আল নূর : ৫৫)
এমনিভাবে স্বপ্নে কান্না দেখলে এর ব্যাখ্যা হতে পারে আনন্দ। স্বপ্নে হাসতে দেখলে এর ব্যাখ্যা হতে পারে দু:খ-কষ্ট।
এ বিপরীত অর্থ গ্রহণ নীতি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার রহস্য হল, স্বপ্নের দায়িত্বশীল ফেরেশতা যখন স্বপ্নে ইঙ্গিত প্রদান করে তখন সে বিষয়টি উল্টো করে দেখায়। কারণ, নিদ্রা আর জাগ্রত অবস্থা একটা আরেকটার বিপরীত।
কয়েকটি প্রসিদ্ধ স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যার বিবরণ
তাবীর বা স্বপ্ন ব্যাখ্যার ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সীরিন রহ.- এর কাছে এক মহিলা আসল। তিনি তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। মহিলা বলল, হে আবু বকর! আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি। ইবনে সীরিন রহ. বললেন, তুমি এক্ষুণি বলবে না আমাকে খেতে দেবে? মহিলা বলল, ঠিক আছে, আপনি খাওয়া শেষ করুন। খাওয়া শেষ করার পর তিনি মহিলাকে বললেন: এখন বল, তোমার দেখা স্বপ্ন। মহিলা বলল : আমি দেখলাম, আকাশের চন্দ্র সাতটি তারা (সূরাইয়া) র মধ্যে ঢুকে গেল। এরপর স্বপ্নের মধ্যে লোকেরা আমাকে বলল, ইবনে সীরিনের কাছে খবরটা তাড়াতাড়ি পৌঁছে দাও।
ইবনে সীরিন বললেন, ধিক! তোমাকে। কি দেখলে? আবার বল। এভাবে কয়েকবার তিনি বললেন। আর তিনি খুব অস্থির হয়ে গেলেন। তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তার বোন তাকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
তিনি বললেন, এ মহিলাটি বলছে আমি সাত দিন পর মৃত্যু বরণ করব।
বর্ণনাকারী আসআছ বলেন : ঠিক সাত দিনের মাথায় আমরা ইমাম ইবনে সীরিন- রহ.-কে দাফন করলাম।
(আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া : শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আস সাদহান)
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বপ্নের কথা শুনতে পছন্দ করতেন। তিনি একদিন জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ গত রাতে স্বপ্ন দেখেছ?
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন : আমি স্বপ্ন দেখেছি, আকাশ থেকে তিনটি চাঁদ আমার ঘরের মধ্যে পতিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমার স্বপ্ন যদি সত্যি হয়, তাহলে তোমার ঘরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিন জন মানুষকে দাফন করা হবে।
এরপরে তো পর্যায়ক্রমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তার ঘরে দাফন করা হয়েছে।
(আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া : শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আস সাদহান। বর্ণনায় : মুস্তাদরাক হাকেম)
ইরাকের শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসূফ একদিন স্বপ্নে দেখলেন, আকাশ থেকে বেহেশতের হুর সাদৃশ দুটো দাসী অবতীর্ণ হল। একজনকে তিনি ধরতে পারলেন অন্য জন আকাশে উঠে গেল।
স্বপ্ন দেখে তিনি খুব খুশী হলেন। এর ব্যাখ্যা জানার জন্য ইমাম ইবনে সীরিন-কে ডাকলেন।
ইবনে সীরিন রহ. বললেন: এর ব্যাখ্যা হল, দুটো বিদ্রোহ (ফিতনা) সংঘটিত হবে। আপনি একটির মোকাবেলা করবেন। অন্যটিকে আপনি পাবেন না। (হয়ত আপনার পরে আসবে)
পরে দেখা গেল হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ, ইবনুল আসআছের বিদ্রোহ মোকাবেলা করলেন। আর ইবনুল মুলাহহাবের বিদ্রোহ তিনি দেখে যাননি।
কিভাবে এ ব্যাখ্যা দেয়া হল? এর রহস্য কী?
এ স্বপ্নে দুটো ইঙ্গিত ছিল। প্রথমটি দাসী আর দ্বিতীয়টি হল বেহেশতের হুর।
দুটো ইঙ্গিত পরস্পর বিরোধী। কারণ, হুর হল সুরক্ষিত। কিন্তু দাসী সুরক্ষিত নয়। অপর দিকে হুরের বিষয়টি দৃশ্যমান নয়, আর দাসীর বিষয়টি দৃশ্যমান। স্বপ্ন ব্যাখ্যার নিয়ম হল, এ রকম পরস্পর বিরোধী ইঙ্গিত দেখলে বাস্তব বা দৃশ্যমান ইঙ্গিত গ্রহণ করা হবে। এ বিবেচনায় এখানে দাসী দেখার বিষয়টি গ্রহণ করা হল আর হুরের বিষয়টি গ্রহণ করা হল না।
আর দাসী হল স্ত্রী নয়, এমন মেয়ে লোক। আর মেয়ে লোক হল ফিতনা-বিশৃংখলার উপকরণ। কেননা রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমার চলে যাওয়ার পর আমার উম্মতের উপর সবচেয়ে ক্ষতিকর ফিতনা হিসাবে মেয়েদের রেখে গেলাম।
তাই ইমাম ইবনে সীরিন এ রকম ব্যাখ্যা করেছেন।
(আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া : শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আস সাদহান)
এ ব্যক্তি ইমাম জাফর সাদিকের কাছে এসে বলল, আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটি হল, একটি কাঁচের পেয়ালা আছে আমার। আমি তা থেকে পানাহার করি। কিন্তু তার মধ্যে একটি পিঁপড়া দেখলাম। সেও তা থেকে খাবার খায়।
এর অর্থ কী?
ইমাম সাহেব বললেন, তোমার কি স্ত্রী আছে? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাসায় কি কোনো পুরুষ কাজের লোক (দাস) আছে? সে বলল, হ্যাঁ আছে। তিনি বললেন, কাজের লোকটিকে বিদায় করে দাও। তাকে রাখায় তোমার কোনো কল্যাণ নেই।
লোকটি বাড়ী গিয়ে স্ত্রীকে স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যার কথা বলল। স্ত্রী বলল, এখন তোমার সিদ্ধান্ত কী?
লোকটি বলল, আমি দাসটিকে বিক্রি করে বিদায় করে দেব।
স্ত্রী বলল, যদি তাকে বিদায় করো তাহলে আমাকে তালাক দাও। লোকটি স্ত্রীকে তালাক দিল। স্ত্রী দাসটিকে কিনে নিল ও তাকে বিয়ে করল।
এ স্বপ্নের মধ্যে তিনটি বিষয়কে ইঙ্গিত হিসাবে ধরা হয়েছে। প্রথম হল, পুরুষ লোকটি। দ্বিতীয় হল, পেয়ালা। আর তৃতীয়টি হল, পিঁপড়া।
ইমাম জাফর সাদেক রহ. ব্যাখা করার আগে পুরুষ লোকটিকে জেনে নিলেন। আর এভাবেই কারো স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার আগে তার সম্পর্কে জেনে নিতে হয়।
দ্বিতীয় ইঙ্গিত, কাঁচের পেয়ালা দ্বারা স্ত্রীকে বুঝায়। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের কাঁচের পাত্রের সাথে তুলনা করেছেন।
তার থেকে পানাহার করার অর্থ হল সহবাস। আর পিঁপড়া ও তার খাওয়ার অর্থ হল সে তার স্ত্রীতে অংশ গ্রহণ করে। পিঁপড়া দ্বারা দুর্বল সত্বা ও চোর বুঝায়। সে এমনভাবে খায়, কেউ দেখে না। এর মানে কাজের লোকটি পিঁপড়ার মত চুপিসারে তার স্ত্রীকে ভোগ করে।
(আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া : শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আস সাদহান)
মৃত ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখা
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সীরিন রহ. বলেন : যদি স্বপ্নে কেউ মৃত ব্যক্তিকে দেখে তাহলে তাকে যে অবস্থায় দেখবে সেটাই বাস্তব বলে ধরা হবে। তাকে যা বলতে শুনবে, সেটা সত্যি বলে ধরা হবে। কারণ, সে এমন জগতে অবস্থান করছে যেখানে সত্য ছাড়া আর কিছু নেই।
যদি কেউ মৃত ব্যক্তিকে ভাল পোশাক পরা অবস্থায় বা সুস্বাস্থের অধিকারী দেখে, তাহলে বুঝতে হবে সে ভাল অবস্থায় আছে। আর যদি জীর্ণ, শীর্ণ স্বাস্থ্য বা খারাপ পোশাকে দেখে তাহলে বুঝতে হবে, ভাল নেই। তার জন্য তখন বেশি করে মাগফিরাত কামনা ও দোআ-প্রার্থনা করতে হবে।
কয়েকটি উদাহরণ :
ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, বিদ্রোহীরা যখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু- এর বাসভবন ঘেরাও করল, তখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি গত রাতে স্বপ্ন দেখলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, উসমান আমাদের সাথে তুমি ইফতার করবে।
আর ঐ দিনই উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হলেন।
(আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া : শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আস সাদহান)
আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আবু মূসা আশ আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি একটি পাহাড়ের কাছে গেলাম। দেখলাম, পাহাড়ের উপরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রয়েছেন ও পাশে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার হাত দিয়ে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর দিকে ইশারা করছেন।
আমি আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ স্বপ্নের কথা শুনে বললাম, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। আল্লাহর শপথ! ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তো মারা যাবেন! আচ্ছা আপনি কি বিষয়টি ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লিখে জানাবেন?
আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তার জীবদ্দশায তার নিজের মৃত্যু সংবাদ জানাব, এটা কি করে হয়?
এর কয়েকদিন পরই স্বপ্নটা সত্যে পরিণত হল। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হয়ে গেলেন।
কারণ, মৃত্যু পরবর্তী সত্য জগত থেকে যা আসে, তা মিথ্যা হতে পারে না। সেখানে অন্য কোনো ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই।
(আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া : শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আস সাদহান)
স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. এর কিছু বক্তব্য
বাস্তব জীবনে ঘটবে এমন কিছু আকৃতি-প্রকৃতি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বান্দাদের দেখিয়ে থাকেন। এ দেখানোটা স্বপ্নে কখনো সরাসরি আবার কখনো ইঙ্গিত বা প্রতীকি বার্তায় হয়ে থাকে।
যেমন আমরা বলে থাকি, স্বপ্নে কাপড় বা জামা দেখার মানে হল দীন-ধর্ম। যদি কাপড় ভাল ও বড় দেখা হয়, তবে তা দীন-ধর্ম, তাকওয়া-পরহেজগারীর উন্নতি নির্দেশ করে। আর তা যদি মলিন, সংকীর্ণ, ছিড়া-ফাটা দেখা হয় তবে তা দীন-ধর্মের অবনতি বলে মনে করা হয়ে থাকে।
দীন -ধর্ম যেমন মানুষের আত্মাকে রক্ষা করে, পোশাক তেমনি মানুষের শরীর-স্বাস্থ্যকে হেফাজত করে। এ জন্য পোশাক আর ধর্ম একে অপরের ইঙ্গিত বহন করে।
স্বপ্নে আগুন দেখা মানে ফিতনা বা বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা নির্দেশ করে। কারণ আগুন দৃশ্যমান ধন-সম্পদ জ্বালিয়ে দেয় আর ফিতনা-অরাজকতা মানুষের অন্তর জ্বালায়। মানুষকে অস্থির করে তোলে।
নক্ষত্র বা তারকা স্বপ্নে দেখলে তার অর্থ হয় আলেম- উলামা, জ্ঞানী-গুণি। কারণ আলেম-উলামা ও জ্ঞানীরা মানুষকে পথ প্রদর্শন করে, আলো দেয়।
স্বপ্নে ইহুদী দেখার অর্থ হল দীন-ধর্মের বিষয়ে অবাধ্যতা আর খৃষ্টান দেখার অর্থ হল, দীন-ধর্মে বিদআত প্রবর্তন ও ধর্মীয় বিষয়ে পথভ্রষ্টতা।
স্বপ্নে লৌহ দেখার অর্থ হল, শক্তি।
আর দাড়ি-পাল্লা দেখার অর্থ হল, ন্যায়পরায়ণতা।
স্বপ্নে সাপ দেখার অর্থ হল, শত্রু ।
স্বপ্নে নীচে পড়ে যেতে দেখার অর্থ হল, অবনতি আর উর্দ্ধে উঠতে দেখার অর্থ হল, উন্নতি।
কোনো অসুস্থ ব্যক্তি যদি স্বপ্নে দেখে সে চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তাহলে এর অর্থ হবে মৃত্যু। আর যদি সে স্বপ্ন দেখে কথা বলতে বলতে সে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তাহলে এর অর্থ হবে জীবন ও সুস্থতা।
যদি কোনো ব্যক্তি স্বপ্ন দেখে যে, সে মৃত্যু বরণ করছে, তাহলে এর অর্থ হবে সে পাপাচার থেকে তওবা করবে। কেননা মৃত্যু মানে হল, আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
অত:পর তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে তাদের সত্যিকার প্রভূ আল্লাহর কাছে। (সূরা আল আনআম : ৬২)
এখানে ফিরিয়ে নেয়া মানে মৃত্যু। আর তাওবা অর্থ ফিরে আসা।
ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু হাবেছ ইবনে সাআদ আত তাঈকে বিচারক হিসাবে নিয়োগ দিলেন। একদিন হাবেছ ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমি স্বপ্নে দেখলাম, চাঁদ আর সূর্য যুদ্ধ করছে। আর নক্ষত্রগুলো দু পক্ষে বিভক্ত হয়ে গেছে।
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ কথা শুনে জিজ্ঞেস করলেন, তখন তুমি কার পক্ষে ছিলে? চাঁদের পক্ষে না সূর্যের?
তিনি উত্তরে বললেন, আমি চাঁদের পক্ষে ছিলাম।
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বললেন, তাহলে আমি তোমার নিয়োগ প্রত্যাহার করে নিলাম। কারণ, তুমি একটি মুছে যাওয়া শক্তির পক্ষে ছিলে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
আর আমি রাত ও দিনকে করেছি দুটো নিদর্শন। অত:পর মুছে দিয়েছি রাতের নিদর্শন (চাঁদকে) আর দিনের নিদর্শন (সূর্য্য) কে করেছি আলোকময়। (সূরা আল ইসরা : আয়াত ১২)
আর তুমি একটি বিভ্রান্তিতে নিহত হবে। পরে দেখা গেল সত্যিই সে সিফফীনের যুদ্ধে সিরিয়াবাসীদের দলে থেকে নিহত হল।
(সুত্র : আল ইসাবাহ ফী তামীযিস সাহাবাহ : ইবনে হাজার রহ.)
স্বপ্নে বাগান দেখার অর্থ হল কাজ ও চাকুরী। আর বাগান পুড়ে যাওয়া দেখলে অর্থ হবে বেকারত্ব ও পতন।
ভাল স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেরীতে হয়
যে স্বপ্নের ফলাফল ভাল তা বাস্তবায়নে দেরী হয়। আর যার ফলাফল খারাপ তার বাস্তবায়নে কোন দেরী হয় না।
দেখুন, ইউসুফ আলাইহিস সালাম স্বপ্নে দেখেছিলেন, চন্দ্র, সূর্য আর এগারটি নক্ষত্র তাকে সিজদা করেছে।
তার এ স্বপ্নটার বাস্তবায়ন অনেক বছর পর হয়েছে।
ইবেন সীরিন রহ. দরবারে একটি শিশুর মৃত্যুর কাহিনীতে আমরা দেখলাম, খারাপ স্বপ্নের বাস্তবায়ন তাড়াতাড়ি হয়ে গেল।
মক্কী জীবনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার স্বপ্ন দেখলেন, যে আবু জাহল জান্নাতে ঘোরা-ফিরা করছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাবলেন, তাহলে আবু জাহল ইসলাম গ্রহণ করবে। কিন্তু করল না। মক্কা বিজয়ের পর যখন আবু জাহলের ছেলে ইকরামা ইসলাম গ্রহণ করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটাই ছিল তার সেই স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন।
(আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া : শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আস সাদহান)
শেষ কথা
আমার এ বিষয়ে লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু পাঠকদের-কে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেয়া নয়। বরং দীনি সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আর এটা যে উলূমে ইসলামিয়ার একটি বিষয় সে ব্যাপারে ধারনা দেয়া। আজ আমরা যারা ইসলামের জন্য নিবেদিত, তারাও যেন দিনে দিনে বস্তুবাদী আর ভোগবাদী হয়ে যাচ্ছি। যে বিষয়ে বাজারে চাহিদা নেই, মানুষ গুরুত্ব দেয় না -সে বিষয়গুলো যত ইসলামি সংস্কৃতির বিষয় হোক- তা আলোচনা করতে চাই না।
ইমাম মালেক রহ. কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সকলে কি স্বপ্নের তাবীর বা ব্যাখ্যা করবে?
তিনি বলেছিলেন, নবুওয়তের একটি বিষয় নিয়ে কি তামাশা করা যায়?
যে ব্যক্তি সঠিক ও সুন্দরভাবে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে জানবে, শুধু সে-ই ব্যাখ্যা দেবে। যদি স্বপ্নটা ভাল হয়, তাহলে বলে দেবে। আর যদি স্বপ্নটা খারাপ হয়, তাহলে ভাল ব্যাখ্যা দেবে। তা সম্ভব না হলে চুপ থাকবে।
(মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবা)
সৌদী আরবের প্রখ্যাত আলেম, ও আল-কোরআনের তাফসীরবিদ, শায়খ আব্দুর রহমান আস সাদী রহ. বলতেন : স্বপ্নের তাবীর বা ব্যাখ্যা উলূমুশ শরইয়্যার একটি বিষয়। এটি শিক্ষা করা ও শিক্ষা দান করার কারণে আল্লাহ তাআলা সওয়াব ও প্রতিদান দেবেন।
(তাইসীরুল কারীম আর রহমান ফী তাফসীরিল কালামিল মান্নান)
সমাপ্ত
সংকলন: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সম্পাদনা: ইকবাল হোছাইন মাছুম
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

বাচ্চাদের প্রাথমিক রুকইয়াহ ও বিধিনিষেধ

প্রাথমিক রুকইয়াহ পদ্ধতিঃ  ১।   মানুষ ও জ্বীনের বদনজর ও জ্বীনের আছর থেকে হিফাযত ও শিফার নিয়তে - দুরুদে ইব্রাহিম, সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি,...