Tuesday, May 28, 2019

ফিতরা দেওয়ার এক সা' প্রসঙ্গে

১৫০৪ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, মুসলিমদের প্রত্যেক আযাদ, গোলাম পুরুষ ও নারীর পক্ষ হতে সদাকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর অথবা যব-এর এক সা‘ পরিমাণ[1] আদায় করা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরজ করেছেন। (সহীহ বুখারী,,অধ্যায় ২৪,, পরিচ্ছেদ ২৪,, বুক অব যাকাত,, হাদিস নাম্বারঃ ১৫০৩) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৪০৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৪১৩)

হাদিসের ব্যাখ্যাঃ
সকল প্রকার খাদ্যদ্রব্য থেকে এক সা‘ পরিমাণ ফিতরা দিতে হবে। এটাই বিভিন্ন সহীহ হাদীসের দাবী এবং নাবী (সাঃ) ও ৪ খলীফাহর যুগের বাস্তব আমল। মু‘আবিয়া (রাঃ) তাঁর খিলাফতকালে যখন আসলেন এবং সেখানে গম আমদানী হল তখন তিনি বললেন, আমার মতে গমের এক মুদ (অন্য বস্তুর) দু’ মুদের সমান। তিরমিযীর বর্ণনায় রয়েছে। فعدل الناس إلى نصف صاع من بر অর্থাৎ লোকেরা গমের অর্ধ সা‘ এর সাথে অন্য বস্তুর এক সা‘ এর সমান হিসাব করলেন। অতএব বুঝা গেল এক সা‘ খেজুর, কিসমিস, পনির, যব এবং অন্য খাদ্য দ্রব্যের যে মূল্য ছিল সে পরিমাণ মূল্য ছিল অর্ধ সা‘ গমের। সে কারণে মু‘আবিয়া (রাঃ) অর্ধ সা‘ ফিতরাহ আদায়ের ফাতাওয়া দিলেন। কিন্তু সহাবীদের অধিকাংশই তাঁর প্রতিবাদ করেছেন। যেমন আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) প্রতিবাদ করে বললেনঃ فأما أنا فلا أزال أخرجه كما كنت أخرجه أبدا ما عشت رواه مسلم আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন সর্বদা ঐভাবেই ফিতরা আদায় করব যেভাবে আগে আদায় করতাম। (মুসলিম ১ম খন্ড ৩১৮ পৃষ্ঠা)

ইমাম হাকিম ও ইবনু খুজাইমাহ সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, عن عياض بن عبد الله بن سعد بن أبي سريح قال : قال أبو سعيد و ذكر عنده صدقة الفطر فقال : لا أخرج إلا ما كنت أخرجه على عهد رسول الله صلى الله عليه و سلم صاعا من تمر أو صاعا من حنطة أو صاعا من شعير أو صاعا من إقط فقال له رجل من القوم : أو مدين من قمح فقال : لا تلك قيمة معاوية لا أقبلها و لا أعمل بها ‘
আইয়ায বিন ‘আবদুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, তার নিকট রামাযানের সদাকাহ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলে তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যামানায় যে পরিমাণ সদাকাতুল ফিতর আদায় করতাম তা ব্যতীত অন্যভাবে বের করব না। এক সা‘ খেজুর, এক সা‘ গম, এক সা‘ যব ও এক সা‘ পনির। কোন ব্যক্তি প্রশ্ন করল, গমের দু’ মুদ দ্বারা কি আদায় হবে না? তিনি বললেন, না। এটা মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মনগড়া নির্ধারিত। আমি সেটা গ্রহণও করব না বাস্তবায়নও করব না। (ফাতহুল বারী ৩য় খন্ড ৪৩৭ পৃষ্ঠা)

ইমাম নাববী (রহঃ) বলেন, যারা মু‘আবিয়ার কথা মত গমের দু’ মুদ আদায় করাকে গ্রহণ করেছে তাতে ত্রুটি রয়েছে। কেননা এ ব্যাপারে সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবাগণ বিরোধিতা করেছেন যাঁরা দীর্ঘ সময় নাবী (সাঃ) এর সাথে ছিলেন এবং তাঁরা নাবী (সাঃ) এর অবস্থা সম্পর্কে অধিক অবগত ছিলেন। মু‘আবিয়া (রাঃ) নিজের রায় দ্বারা মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি নাবী (সাঃ) হতে শুনে বলেননি। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর হাদীসে ইত্তিবাহ ও সুন্নাত গ্রহণের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। (ফাতহুল বারী ৩য় খন্ড ৪৩৮ পৃষ্ঠা, মুসলিম শরহে নাববী ১ম খন্ড ৩১৭-৩১৮ পৃষ্ঠা, শরহুল মুহাযযাব ইমাম নাববী) ইমাম শাফিয়ী, আহমাদ, ইসহাক এক সা‘ ফিতরায় হাদীস প্রমাণ পেশ করেন। কেননা নাবী (সাঃ) সদাকাতুল ফিতর খাদ্যদ্রব্যের এক সা‘ আদায় করা ফরয করেছেন। আর গম হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যেরই একটি। অতএব এক সা‘ ব্যতীত ফিতরা আদায় বৈধ হবে না। আর আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ), আবুল আলিয়া, আবুশ শা’সআ, হাসান বাসরী, জাবির বিন যায়িদ, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ও ইসহাক (রহ.) প্রমুখ এ দলীল গ্রহণ করেছেন। নাইলুল আওতারে এভাবেই রয়েছে। তাতে আরো রয়েছে গম ও অন্য খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে না। আর যারা অর্ধ সা‘ গমের কথা যে হাদীসগুলির দ্বারা বলে তা সম্পূর্ণ যঈফ। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৩য় খন্ড ২৮০-২৮১ পৃষ্ঠা) এ বিষয়ে সকল হাদীস পর্যালোচনা করে দেখা যায় মু‘আবিয়া (রাঃ) যখন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, হাজ্জ মৌসুমে হাজ্জ করে যখন লোকদের সাথে কথা বললেন তখন জানতে পারলেন শাম বা সিরিয়ার এক মুদ গমের যে দাম হিজাযের দু’ মুদ খেজুর, কিসমিস ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের একই দাম অথবা যখন হিজাযে গম আমদানী হল তখন দেখা গেল এক সা‘ খেজুর বা কিসমিসের মূল্য অর্ধ সা‘ গমের মূল্যের সমান। তাই মু‘আবিয়া (রাঃ) দামের দিক দিয়ে সমান করে দুই মুদ বা অর্ধ সা‘ গম আদায়ের কথা বলেন এবং সাহাবাদের প্রতিবাদের মুখে পড়েন।

রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যামানায় দীনার, দিরহাম ইত্যাদি মুদ্রা চালু ছিল। কিন্তু দীনার দিরহামের দ্বারা অর্থাৎ আমাদের যামানায় প্রচলিত টাকা পয়সার দ্বারা যাকাতুল ফিতর আদায় করার প্রমাণ কোন হাদীসেই পাওয়া যায় না। তাঁরা তাঁদের খাদ্যবস্তু দিয়েই ফিতরা আদায় করতেন। আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর এ ব্যবস্থাপনায় বহুবিধ কল্যাণ নিহিত আছে। ফিতরাহ দানকারী যখন ফিতরার খাদ্যবস্তু কিনে তখন বিক্রেতা উপকৃত হয়। ফিতরাহ গ্রহণকারী খাদ্যবস্তু বিক্রি করে দিলে ফিতরাহ গ্রহণ করে না এমন সব গরীব ক্রেতা উপকৃত হয়। والله أعلم
ফিতর টাকা দিয়ে নাকি খাদ্য দিয়ে দিতে হবে এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে নিম্ন লিংকের ব্লগটি পড়ুনঃ
https://kmarifin.blogspot.com/2020/05/blog-post_14.html?m=1 ➽ সা’ হচ্ছে মূলত একটি পাত্রের নির্দিষ্ট পরিমান দ্রব্য !!!

সা’ এর পরিমান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরী হচ্ছে! কেউ বলছে ২.৪০০ কেজি (২ কেজি ৪০০ গ্রাম), কেউ বলছে ২.১০০ কেজি (২ কেজি ১০০ গ্রাম), কেউ বলছে ২.০৪০ কেজি (২ কেজি ৪০ গ্রাম) , কেউ বলছে ৩ কেজি, আবার কেউ বলছে ৩.৩০০ কেজি (৩কেজি ৩০০ গ্রাম)! আরো বিভিন্ন মত থাকতে পারে!
এত পার্থক্য কেন? কোনটা মানব?
আসলে পার্থক্য তৈরী হয়েছে সা’ না বুঝার কারণে অথবা একেক দেশে একেক প্রচলিত ফসলের কারণে।
মূলত রাসুল (সাঃ) সা’ হচ্ছে একটি পাত্র। তিনি যখন ফিতরা দিতেন ওই পাত্র ভরে পাকা পুষ্ট গম বা খেজুর দিতেন । বুখারী মুসলিম।
এক সা’ = (৪) চার মুদ।
১ মুদ = একটি নির্দিষ্ট আকারের পাত্রের পরিমানকে মুদ বলা হয়, কাপ বা বল বা মগ জাতীয় । যার আনুমানিক পরিমান ১জন প্রমাণ সাইজের মানুষের দুই হাত মুনাজাতের মত একত্রিত করে তাতে যতটুকু ফসল নেয়া যায় ।
ওই পাত্রের আকারে ১ মুদ = আনুমানিক প্রায় ০.৭৫০ লিটার অর্থাত ৭৫০ মিলি লিটার! এখন ৭৫০ মিলি লিটার আয়তনের পাত্রে ফসল ভরলে যতটুকু হয় তা হচ্ছে এক মুদ।
তাহলে ১ সা’ = ৪ মুদ = ৪ x ০.৭৫০ মিলি লিটার = ৩ লিটার। এখন ১ সা’ ফসল = ৩ লিটার পাত্রে যেই পরিমান ফসল ধরে ।
স্বাভাবিকভাবে এভাবে একেক ফসলের ওজন ভিন্ন ভিন্ন হবে !
শায়খ সালেহ আল উসায়্মিন ফতোয়া আরকানুল ইসলামে উল্লেখ করেছেন, রসুল (সাঃ) এর এক সা’ ছিল আনুমানিক ২ কেজি ৪০ গ্রাম পাকাপুষ্ট গম।
এখন ওই পাত্রের পরিমান অনুযায়ী পাকা পুষ্ট গমের কেজি করলে তা দাড়ায় ২ কেজি ৪০ গ্রাম !
এখন ওই পাত্রে যদি খেজুর পূর্ণ করে ওজন দেয়া হয় তখন তো আর ২ কেজি ৪০ গ্রাম হবে না ! বেশি হতে পারে! কারণ খেজুরের আয়তন বড় এবং ওজন বেশি !
একইভাবে যদি ওই পত্র পূর্ণ চাল ওজন দেয়া হয় তাহলেও ওজনের তারতম্য ঘটবে !!
স্কলারগণ মানুষের সুবিধার্থে এই কেজির সংখ্যা নিরুপন করেছেন । যে গম হিসেবে তা ২ কেজি ৪০ গ্রাম থেকে শুরু করে প্রায় ৩ কেজি পর্যন্ত। এই সা’র ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণের বিভিন্ন মতের পর একটি সুন্দর, সহজ ও নির্ভরযোগ্য ওজন প্রমাণিত হয় যা, সর্বকাল ও সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তা হল: একজন সাধারণ শারীরিক গঠনের মানুষ অর্থাৎ অধিক লম্বা নয় এবং বেঁটেও নয়, এই রকম মানুষ তার দুই হাত একত্রে করলে যে অঞ্জলি গঠিত হয়, ঐরকম পূর্ণ চার অঞ্জলি সমান হচ্ছে এক সা'। [ফাতাওয়া মাসায়েল/ ১৭২-১৭৩, সউদী ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি, ফতোয়া নং ৫৭৩৩ খণ্ড ৯ম, পৃ: ৩৬৫ ]

ফিতরা হচ্ছে একটা দান, সদকাহ। অতএব একটু বেশি দেয়ার সমর্থ থাকলে দিলে সমস্যা কি?
না হয় সাড়ে ৩ কেজিই দিলেন ! (সংগৃহীত ও সংযোজিত)

Own experiment: (11-05-2020)

১ সা = ৩ লিটার হিসাব মতে আমি নিজে পরিমাপ করে পেলাম ২ কেজি ৬৭৭ গ্রাম (সাদা মোটা নতুন চাল)
এর প্রতি কেজির বর্তমান মূল্য খুচরা= ৫৫ টাকা
প্রতি কেজির মূল্য পাইকারী পরেছে ৫২.৫ টাকা

আমার ভাইয়ের হাতের ৪ কোশ দ্বারা পরিমাপ করিয়ে পেলাম প্রায় ১.৬৫ কেজি (১ কেজি ৬৫০ গ্রাম)।
আমার আব্বুর হাতের ৪ কোশ দ্বারা পরিমাপ করিয়ে পেলাম প্রায় ১.৯৫ কেজি (১কেজি ৯৫০ গ্রাম)।
অতএব দেখা গেলো মানুষভেদে পরিমানের তারতম্য ঘটছে! কারন, ব্যক্তিভেদে হাত ছোট /বড় হয়, আবার কোশ ধরার কৌশলগত কারনে যেমন মেলিয়ে ধরা বুঝিয়ে ধরা ইত্যাদি কারন।

সুতরাং আমার মতে স্টান্ডার্ড লিটার হিসাব মতে উক্ত চাল ২.৭ কেজি (২ কেজি ৭০০ গ্রাম) করে ফিতর হিসেবে দেওয়াই যথেষ্ট হবে ইংশাআল্লহ। তবে এর চাইতে বেশি দেওয়া আরো উত্তম কিন্তু এর থেকে কম দেওয়া উচিত নয়।
والله أعلم (মহান আল্লাহ ভালো জানেন)

No comments:

Post a Comment

বাচ্চাদের প্রাথমিক রুকইয়াহ ও বিধিনিষেধ

প্রাথমিক রুকইয়াহ পদ্ধতিঃ  ১।   মানুষ ও জ্বীনের বদনজর ও জ্বীনের আছর থেকে হিফাযত ও শিফার নিয়তে - দুরুদে ইব্রাহিম, সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি,...